প্রসঙ্গঃ ‘৭ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে শরীফার গল্প ও ভার্সিটি শিক্ষকের বইয়ের পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ’

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৪

 

।। এম আর আয়াজ রবি ।।
বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ, কর্তৃক প্রণীত নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির জন্য পরীক্ষামূলকভাবে অনুমোদিত ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ‘শরীফার গল্প’ নামে একটি গল্প দেওয়া হয়েছে। এই গল্পের মূল চরিত্র শরীফা জন্মগতভাবে পুরুষ হলেও নিজেকে নারী বলে দাবি করে এবং তার পূর্বের নাম পরিবর্তন করে ‘শরীফা’ নামে পরিচিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে শরীফা ‘ হিজড়া’ সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে জীবনযাপন করতে থাকে।
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডার নারীর গল্প অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দর্শনের শিক্ষক আসিফ মাহতাব নামক এক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। মাহতাব বলেন, ‘এটা আমাদের বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করার চেষ্টা। আমি হিজড়াদের অধিকার রক্ষার পক্ষে। কিন্তু এই গল্প তাদের সাহায্য করবে না,’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মাহতাব শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যক্রমের একটি বইয়ের দুটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছেন, যেখানে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর গল্প রয়েছে।
ওই গল্পে বর্ণনা করা হয়েছে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী, যিনি একজন পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কীভাবে নারীর মতো আচরণের কারণে পরিবার এবং সমাজে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। একটি ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ে যোগদান করার পর এবং তাঁর নাম পরিবর্তন করার পরে তিনি মানসিক শান্তি পেয়েছিলেন।
এই ঘটনার পরে , টক অব দ্যা কান্ট্রি হয়েছে শরীফার গল্প ও ব্রাক ভার্সিটির শিক্ষক আসিফ মাহতাবের পাঠ্যপুস্তক ছিঁড়ে ফেলা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সেই শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতি।
তাই কৌতুহলী মনে, অনেকের মতো শরীফার গল্পটি বার বার পড়ে মনে হয়েছে-সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সামাজিক অসংগতি তুলে ধরতে গিয়ে সমাজের ‘থার্ড জেন্ডার’ হিসেবে পরিচিত ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা এবং হিজড়াদের প্রতি বৈষম্য না করার প্রতি দিকনির্দেশনা দেওয়ার অভিপ্রায়েই গল্পটির অবতারণা। উল্লেখিত গল্পে শরীফার জবানিতে লিখা হয়েছে– ‘একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, ‘আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম ‘ট্রান্সজেন্ডার’’ (‘শরীফার গল্প’, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ৭ম শ্রেণি, ২০২৩, পৃষ্ঠা নং- ৫১)।
প্রকৃতপক্ষে, এটি আমাদের সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন সংগ্রাম ও কষ্ট-বেদনার দারুন মর্মস্পর্শী গল্প। এই গল্পের মাধ্যমে সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা ও মন-মানসিকতা রয়েছে তা উত্তরণের একটি দারুণ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। এনসিটিবির এই উদ্যোগটি মহৎ ও প্রশংসাযোগ্য।
তবে খুব সচেতনভাবে পড়লে দেখা যায়, এই গল্পে দুইটি জায়গায় ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমস্থানে পড়লে মনে হতে পারে, লেখক ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি ‘হিজড়া’ বা তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ভারতবর্ষে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে ‘হিজড়া’ নামে ডাকা হয়। মূলত এই শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে ‘ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া’ শব্দটি ব্যবহার করে লেখক বুঝিয়েছেন, তিনি ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ও ‘হিজড়া’ শব্দের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন। এছাড়াও ওই গল্পের ভেতরে যে চারজন হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের ছবি দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন মূলত হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তারা কেউ ট্রান্সজেন্ডার নয়।
পুরো গল্পে এই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটির ব্যবহারই যত বিরোধ ও আপত্তির মূল কেন্দ্র বলে মনে হয়েছে। এই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি ব্যবহার না করলে এই গল্প নিয়ে কারো কোন আপত্তি থাকতো না- এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কেননা এই আপত্তির কারণ বুঝতে হলে, সেক্স ও জেন্ডার শব্দের পার্থক্য জানা জরুরী। একই সাথে ইন্টার সেক্স, ট্রান্সজেন্ডার, ট্রান্সসেক্স, হোমো সেক্স ও বাইসেক্স শব্দগুলোর সঠিক সংজ্ঞা ও পার্থক্য জানা জরুরী (গুগলে এ বিষয়ে বিষদ বর্ণনা রয়েছে)। হিজড়া ( থার্ড জেন্ডার ) ও রূপান্তরকামী ( ট্রান্সজেন্ডার) লিঙ্গ বা মানুষের পার্থক্য জানা জরুরী। একজন ব্যক্তি জন্মগতভাবে হয় পুরুষ হবে অথবা মহিলা হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তথা হিজড়াও দেখা যায়। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া কখনোই এক জিনিষ নয়।

বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা জানি, মানুষের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম থাকে । এর মধ্যে ২২ জোড়া হলো অটোজম আর ১ জোড়া হলো সেক্স ক্রোমোজম । এই ২২ জোড়া অটোজম নারী পুরুষ সকলের শরীরে একইরকম হয়ে থাকে । বাকি ১ জোড়া সেক্স ক্রোমোজম নির্ধারন করে মানুষের শারীরিক লিঙ্গ । এই ১ জোড়া সেক্স ক্রোমোজম হলো এক্স এক্স ( XX) অথবা এক্স ওয়াই ( XY)। এক্স এক্স ( XX) হলে মেয়ে আর এক্স ওয়াই (XY ) হলে ছেলে । অর্থাৎ, শিশুর ক্রোমোজমের প্যাটার্ন যদি এক্স এক্স ( XX) হয় তাহলে সে শিশুটি হবে মেয়ে, আর শিশুর ক্রোমোজমের প্যাটার্ন যদি এক্স ওয়াই ( XY) হয়, তাহলে সে শিশুটি হবে ছেলে । এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক । কিন্তু প্রবলেম টা হলো, সকল শিশুর ক্রোমোজমের প্যাটার্ন এই এক্স এক্স ( XX) বা এক্স ওয়াই ( XY) প্যাটার্নের হয় না অর্থাৎ চিরাচরিত এই এক্স এক্স (XX) / এক্স ওয়াই ( XY) প্যাটার্নের সাথে মিলে না ।
গর্ভাবস্থায় হরমোনাল বা জেনেটিক্যাল ত্রুটির কারনে কিছু কিছু শিশুর ক্রোমোজমের প্যাটার্ন একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । যেমন, XO / XXX / XXY / XYY ।
এইসব শিশুর ক্রোমোজমের প্যাটার্ন XX / XY না হওয়ার কারনে অর্থ্যাৎ স্বাভাবিক ছেলে বা মেয়েদের মতো না হওয়ার কারনে তাদের শারীরিক লিঙ্গও স্বাভাবিক ছেলে বা মেয়েদের লিঙ্গের মত হয় না । ফলে, জন্মের পর এইসব শিশুর লিঙ্গ নির্ধারনে বেশ জটিলতা দেখা দেয় । অর্থাৎ, এইসব শিশুর লিঙ্গ দেখে সহজে বুঝা যায় না যে, শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে ।
এসব শিশুদের মধ্যে কারো কারো লিঙ্গ আংশিকভাবে ছেলেদের মতো বা আংশিকভাবে মেয়েদের মতো হয় । তবে পুরোপুরি ছেলে বা মেয়ে কোনোটার মতোই হয় না । আবার কারো কারো লিঙ্গ আংশিকভাবেও ছেলে বা মেয়েদের মতো হয় না, পুরোপুরিই আলাদা ।
আমাদের দেশে এমন ভিন্ন ধরনের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো শিশুদেরই সাধারণত হিজরা শিশু বা হিজরা বাচ্চা বলা হয় ।
প্রতিবছর সারা বিশ্বব্যপী জন্ম নেওয়া মোট শিশুর মধ্যে গড়ে ১.৭% শতাংশ শিশু ইন্টারসেক্স ডিসওর্ডার নিয়ে জন্মগ্রহন করে । তবে দেশ ও অঞ্চল ভেদে এ পরিসংখ্যানের কিছুটা তারতম্য হতে পারে ।

একজন পুরুষ যদি নিজেকে মহিলা দাবী করে, তাহলে সে ট্রান্সজেন্ডার (মহিলা) হিসেবে পরিচিত। যেহেতু ট্রান্সজেন্ডার চিন্তাধারাটি শুধুমাত্র মনের সাথে সম্পৃক্ত। তাই এতে কোনোরূপ সার্জারি, অপারেশন করা লাগে না। শুধুমাত্র মনে মনে নিজেকে ছেলে থেকে মেয়ে বা মেয়ে থেকে ছেলে দাবী করলেই তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলা হবে। মেডিকেল প্রক্রিয়া ট্রান্সজেন্ডারে রূপান্তর হওয়া অনেক ব্যয়বহুল, যা ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও বটে।

নারীবাদীরা মনে করেন ‘সেক্স’ হলো একটি বায়োলজিক্যাল পদ, অন্যদিকে ‘জেন্ডার’ হলো সোশালি কন্সট্রাকটেড একটি পদ। নারীবাদী দার্শনিক হ্যাসল্যাঙ্গারের মতে ‘woman is the social meaning of female’. অর্থাৎ ফিমেইল হলো একজন নারীর বায়োলজিক্যাল লিঙ্গ (সেক্স)। অন্যদিকে, তার আচার আচরণ, তার কথা বলার ধরন, এক কথায় তার জীবনাচরণ কী রকম হবে সমাজের বেঁধে দেওয়া বৈশিষ্ট্যের আলোকে একজন ব্যক্তির যে লৈঙ্গিক পরিচয় তৈরি হয় সেটা তার সামাজিক লিঙ্গ (জেন্ডার)। মানুষ জন্মগতভাবে যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মায় সেই লৈঙ্গিক পরিচয়ে যখন শনাক্ত হয় তখন তাকে সিস-জেন্ডার বলে। অন্যদিকে, একজন ব্যক্তি যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মায় পরবর্তীতে যদি তার বিপরীত লৈঙ্গিক পরিচয়ে শনাক্ত হয় তবে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলে। এক্ষেত্রে নারী থেকে কেউ পুরুষে রূপান্তরিত হলে তাকে ট্রান্সম্যান আবার পুরুষ থেকে কেউ নারীতে রূপান্তরিত হলে তাকে ট্রান্সউইম্যান বলা হয়। এই জেন্ডার ট্রান্সফরমেশনের বিষয়টি প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম দুভাবেই হতে পারে।

অন্যদিকে, কোনও কোনও ব্যক্তি নিজেদের শারীরিক পরিবর্তন (সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট এবং হরমোন পরিবর্তন) না করেও নিজেকে তার জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গের দাবি করে থাকে। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি বায়োলজিক্যালি পুরুষ কিন্তু নিজেকে নারী বলে দাবি করে তাকে বলে ‘উইম্যান ইন মেইল বডি’ (বা ‘উইম্যান ব্রেইন ইন মেইল বডি’), আর যে ব্যক্তি বায়োলজিক্যালি নারী কিন্তু নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করে তাকে বলা হয় ‘ম্যান ইন ফিমেইল বডি’ (বা ‘মেইল ব্রেইন ইন ফিমেইল বডি’)। ‘শরীফার গল্প’-তে শরীফা জন্মগতভাবে পুরুষ হলেও সে নিজেকে নারী বলে দাবি করে, অন্যদিকে শরীফার পরিচিত ব্যক্তি শারীরিক দিক দিয়ে নারী হলেও মানসিকভাবে নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করে। অনেকে এই ধরনের ব্যক্তিকে ‘টু-স্পিরিট’ ব্যক্তিও বলে থাকে। ফলে ‘নারী’কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে যাতে করে ট্রান্সউইম্যান নারীরা সেই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিংবা এই ধরনের ‘টু-স্পিরিট’ ব্যক্তিরা বাইনারি জেন্ডারের জাল থেকে বের হয়ে আসতে পারে সেই বিষয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা এবং বিতর্ক। অনেক দার্শনিক কৃত্রিম উপায়ে নিজেদের জেন্ডার পরিবর্তনের প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছেন এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার হিসেবে, যাকে বলা হয় “Gender Identity Disorder (GID)”

আমরা যদি ধরি ‘শরীফার গল্প’ নামক গল্পে শরীফা কিংবা তার পরিচিত উভয়েরই একটা ট্রান্স আইডেন্টিটি আছে, তবে মেনে নিতে হবে যে শরীফার পরিচয় (ট্রান্স) নারী অন্যদিকে শরীফার পরিচিত ব্যক্তির পরিচয় (ট্রান্স) পুরুষ। অতএব, ‘আমরা ছেলেও নই মেয়েও নই, আমরা হলাম ট্রান্সজেন্ডার’ একটি স্ববিরোধী বাক্য। কেননা, এখানে “ট্রান্সজেন্ডার” বললে তাকে “নারীও নয় বা পুরুষও নয়” বলা যায় না। আবার “নারীও নয় পুরুষও নয়” বললে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলা যায় না। অর্থাৎ, পুরো বিষয়টাই একটা দার্শনিক বিতর্কের বিষয়। অন্যদিকে, হিজড়া একটি সম্প্রদায় যে সম্প্রদায়ের সদস্যরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেরা আলাদাভাবে বসবাস করে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেরই শারীরিক ত্রুটির [লৈঙ্গিক (সেক্স) পরিচয়জনিত সমস্যা] কারণে ব্যক্তি তার পরিবার এবং মূলধারার সমাজে বিভিন্নভাবে বৈষম্য এবং নিগ্রহের শিকার হয়। ফলে, তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একই ধরনের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মূল ধারার সমাজে নিগৃহীত অপর ব্যক্তিদের সঙ্গে মিলে নিজেরা একটা আলাদা সমাজ তৈরি করে।

আমি দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই অনুযোগ করে বলেছেন, এই গল্প সমকামিতাকে প্রমোট করছে। আমার কাছে মনে হয় না এই অভিযোগ সঠিক। মানুষ তার সহজাত যৌন চাহিদা পরিপূরণ করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই তার বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীকে বেছে নেয়। যখন একজন নারী তার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গী হিসেবে একজন পুরুষকে বেছে নেয়, কিংবা একজন পুরুষ তার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গী হিসেবে একজন নারীকে বেছে নেয়, সেই নারী বা পুরুষকে heterosexual বা বিপরীতকামী কিংবা বিষমকামী বলা হয়। অন্যদিকে, একজন নারী যদি তার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গী হিসেবে অপর একজন নারীকে বেছে নেয় এবং একজন পুরুষ যদি তার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গী হিসেবে অপর একজন পুরুষকে বেছে নেয়, তবে তাকে homosexual বা সমকামী বলা হয়। ২০২৩ সালের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘শরীফার গল্প’ পড়ে আমি যেটা বুঝেছি তাতে শরীফা কিংবা তার পরিচিত জনৈক ব্যক্তিকে সমকামী বলা যায় না। কারণ, শরীফা এবং তার পরিচিত ব্যক্তি উভয়ের ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক পরিচয় শনাক্তকরণেই মূল সমস্যা বলে দেখানো হয়েছে, সেখানে তাদের বৈবাহিক আলোচনা কিংবা বিশেষ মুহূর্তে কোনও ধরনের সঙ্গী প্রত্যাশা করে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়নি। তাই এক্ষেত্রে সমকামিতা প্রমোট করার অভিযোগ অবান্তর।

সে যাহোক, মূল কথা হলো আমি যতদূর বুঝেছি ৭ম শ্রেণির বইয়ে শরীফার ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনও জটিলতা নেই, কারণ প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম উপায়ে তার কোনও লিঙ্গান্তর হয়নি। তাই শরীফাকে আপাতদৃষ্টিতে আমার কাছে মনে হচ্ছে ‘টু-স্পিরিট’ ব্যক্তি, যার শারীরিক কোনও জটিলতা নেই, বরং মূল সমস্যাটা হয়েছে তার চিন্তায়, যেহেতু সে নিজেকে তার জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গ মনে করছে । পাঠ্যপুস্তকের উল্লিখিত গল্পে লেখক সুপরিকল্পিতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের জীবন সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট ও তাদের অধিকার এবং স্বীকৃতির সুন্দর একটি গল্পের মধ্যে অত্যন্ত সুক্ষ্ণপরিকল্পিতভাবে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি প্রবেশ করিয়ে মূলত আমাদের সমাজে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীদের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে প্রতিবাদকারীদের দাবি। আমি মনে করি, এই দাবি যৌক্তিক। হতে পারে এনসিটিবির সম্পাদকমন্ডলীরও বিষয়টি সচেতনতার অভাবে দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। যেটা তৃতীয় শ্রেণীর ইসলাম শিক্ষা বইয়ের ক্ষেত্রে হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন । জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই ধরনের অবহেলা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
( লেখকঃ কলামিষ্ট, পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী)