সংবিধানের আলোকে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম বোবার শত্রু নেই’ কথাটির সামাজিক বাস্তবতা

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪

 

।। এম আর আয়াজ রবি।।

ফেব্রুয়ারী ভাষার মাস। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য পৃথিবীর বুকে একমাত্র বাঙালি জাতিই বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেই বলতে চাই-আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি, প্রতিদিন বলি, যখন তখন বলি, ইচ্ছে করে বলি, ইচ্ছে না হলেও বলি, প্রয়োজনে বলি, অপ্রয়োজনে বলি। সত্যের পক্ষে কথা বলি আবার সত্যের বিপক্ষেও কথা বলি। ভেবে কথা বলি, আবার কখনো না ভেবেই কথা বলি। গায়ে পড়ে কথা বলি কিংবা গা বাঁচানোর জন্য কথা বলি। কোন কথা আমাদের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক আবার কোন কথা অসামাজিক, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আবার কোনটা একেবারেই অরাজনৈতিক। কোনটা নিজে বাঁচার জন্য, নিজের ইজ্জত সম্মান বাঁচানোর জন্য, কোনটা পরিবার, সমাজ ও দেশের মান রক্ষা ও বাঁচানোর জন্য, কোনটা পাড়া প্রতিবেশিদের পক্ষে, কোনটা সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের পক্ষে অথবা কোনটা বিপক্ষে! আমরা নির্দিষ্ট সীমারেখার ভেতরে থেকেই কথা বলি আবার সীমারেখা অতিক্রম করেও কথা বলি! এটাই আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি।

তবে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ এর মতে, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সংবিধানের ৩৬ নং ৩৭ নং ও ৩৮ নং অনুচ্ছেদে যথাক্রমে চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা ও সংগঠনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।

সংবিধানে উল্লেখিত ফ্রিডম অব স্পিচ (freedom of speech), ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন (freedom of expression) টার্মগুলো এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাংলাদেশের সংবিধানে ফ্রিডম অব থট এবং ফ্রিডম (freedom of thought) অব কনসায়েন্স (freedom of conscience) নামে আলাদা দুটি টার্ম রয়েছে।

সংবিধানের ফ্রিডম অব স্পিচ মানে বোঝানো হয়েছে বাক (কথা) প্রকাশের স্বাধীনতা অর্থাৎ মৌখিক কথা বলার স্বাধীনতা, ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন মানে বোঝানো হয়েছে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, ফ্রিডম অব থট মানে বোঝানো হয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা, ফ্রিডম অব কনসায়েন্স মানে বোঝানো হয়েছে বিবেকের স্বাধীনতা।

পরিশেষে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ব্যাখ্যা ধরে যে শব্দগুলো পাওয়া গেল অর্থাৎ বাক, ভাব, চিন্তা এবং বিবেক; তা সামগ্রিকভাবে একজন মানুষের মতরুপে প্রকাশিত হয়। সুতরাং মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার।

কিন্তু অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায়-কেন আমরা কথা বলি? এই “কথা বলা আমাদের অধিকার” এ জন্যেই কি শুধু কথা বলি নাকি কথা বলাটা একটা কর্তব্যও বটে? যখন তখন, যা খুশি , যা ইচ্ছে তাই কথা বলব নাকি, পরিশীলিত ও যথোপযুক্ত মাত্রাই কথা বলব? শুধুমাত্র কথা বলাই কি মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ নাকি সংবাদ পত্র, ব্যঙ্গচিত্র, ধর্ম পালন ইত্যাদি এসবও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত? এইসব প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা একটা বিষয়ের দিকে আমাদেরকে নির্দেশ করছে, সেটা হলো, কথা বলার অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার। সেটা কথা বলেই হোক আর ব্যঙ্গচিত্র কিংবা সংবাদ প্রকাশ অথবা ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমেই হোক না কেন। আমাদের এই অধিকার কতটুকু বা কতখানি যেখান থেকে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলব কিংবা কিভাবে বুঝবো যে, কোনটা কথা প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর না উপকারি, অনুমোদিত না অননুমোদিত বা কোনটা অধিকার বর্জিত সেটা ঠিক করার মাপকাঠি কোনটা হতে পারে সেদিকটাই মুলত আমাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত।

অনেকেই রসিকতা করে বলেন,
‘বোবার শত্রু নেই, বোবা হয়ে থাকুন। চোখে ছানি পড়লে কাটাবেন না, দৃষ্টি যত ঝাপসা, বেঁচে থাকার আনন্দ তত বেশি। কানে কম শুনলে আপনি সুখী ব্যক্তি। কারণ যেসব কথা শুনলে মেজাজ বিগড়ে যায়, মন খারাপ হয় সেসব কথা আপনাকে শুনতে হয় না। কোনো মনঃকষ্টও তাই থাকে না’।

এই রসিকতার আড়ালে রয়েছে আসলে এক নির্মম সমাজ-বাস্তবতা। আমাদের সমাজে এমন সব ঘটনা ঘটছে, এক শ্রেণির মানুষ এমন সব কথা বলছে, এমন বেপরোয়া আচরণ করছে, তাতে প্রতিবাদ না করে চুপচাপ থাকাটা খুব কঠিন। আর প্রতিবাদী হলে, উচিত কথা বললে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমগুলো আছে মহাসমস্যায়। চোখ-মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করাও যায় না, আবার সত্য কথা বললেও বিপদ ও হয়রানি বাড়ে। কোনো মত-মন্তব্য ও খবর কর্তাব্যক্তিদের অপছন্দ হলেই তার ওপর খড়্গ নেমে আসছে।

অন্যদিকে গনমাধ্যম তথা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মাধ্যমের কথাই বলি-মিথ্যা, পক্ষপাতদুষ্ট বা মতলবি খবর প্রকাশ বা তিলকে তাল বানিয়ে কোনো ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানকে তুলোধোনা করাটা নিঃসন্দেহে অপসাংবাদিকতা। এটা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মিথ্যে-বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন, অপসাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিকতা করা উচিত কি না সেটা যেমন সংশ্লিষ্ট সবার ভেবে দেখা দরকার, পাশাপাশি সরকারেরও সমালোচনা হজম করার শক্তিটা আরও বাড়ানো দরকার। কেউ কিছু বললেই কেন তাকে উচিত শিক্ষা দিতে উঠেপড়ে লাগতে হবে? সবাইকে কি আর আইন আর শাস্তির ভয় দেখিয়ে সোজা করা যাবে? না তা উচিত? আসলে আমাদের সবার শুভবুদ্ধির উন্মেষ বড় বেশি প্রয়োজন! আর শুধু সাংবাদিকতা নয়, আমাদের প্রত্যেকের আচার-ব্যবহার, লেখালেখি, শব্দচয়ন, বাক্য ব্যবহার এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। অন্যের ক্ষতি হয়, কারও মনে আঘাত লাগে, সামাজিক স্থিতি বিনাশ হয় এমন কিছু করা বা বলা আমাদের কারোরই উচিত নয়। আবার এর ভিন্ন দিকও আছে। এই আশঙ্কাও হয়, ‘দায়িত্বশীল’ হতে হতে, বুঝতে বুঝতে, শব্দ-বাক্য-গলা হ্রস্ব করতে করতে আমরা আবার বোবা হয়ে যাব না তো?

কেউ কোনো কথা বললে, ইনটেনশনটা আগে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। বোবার শত্রু নেই। সবকিছু থেকে রেহাই পাওয়া যায়, কথাবার্তা বন্ধ করে দিলে। কোনো কিছু না বললে, না লিখলে। কিন্তু ‘বোবার পৃথিবী’ বা ‘কবরের নীরবতা’ নিশ্চয়ই আমাদের কারোরই কাংখিত নয়! তাই দেশের পক্ষে, সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, আর্ত-নিপীড়িত মানবতার পক্ষে কথা বলা উচিত।
( লেখক: কলামিস্ট, পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী)