উখিয়া টেকনাফের অরক্ষিত সীমান্ত, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত মাদক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি এবং বাস্তবতা

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৩

।। এম আর আয়াজ রবি।।

মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা ও সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় উখিয়া টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্টি অতি সহজে মাদক ব্যবসা, মাদক গ্রহন বা মাদক বিস্তারের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত হয়ে পড়ছে। মাদকের অবাধ প্রবাহ ও সহজলভ্যতার কারনে যুব সমাজ তিলে তিলে ধ্বংসের প্রান্ত সীমায় পৌছেছে ! তাছাড়া, অনেকক্ষেত্রে সীমান্ত উন্মুক্ত ও অরক্ষিত হওয়ার কারনে অতি সহজে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্টি এদেশে প্রবেশ যেমন করতে পারছে আবার ফিরেও যেতে পারছে অবাধে। এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্টি ইয়াবা, মাদক কারবার ও বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে অতি দ্রুত। তাদেরকে পৃষ্টপোষকতা দিচ্ছে এদেশীয় কিছু অতি লোভী, রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার হীন ইচ্ছার স্বার্থান্বেষী মহল-জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সাথে জড়িত নেতা নেতৃ, নেতা, পাতি নেতা, ভুঁইফোড় নেতা, এলাকার শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার জনগোষ্টি, সাধারণ আমজনতা। তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা ঠিকাদারী প্রতিষ্টান, কনষ্ট্রাকশন ফার্ম, সরবরাহকারী, সিএনজি/ বাস/ ট্রাকের ড্রাইভার,হেলপার, বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিসহ অনেক স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল।

অনেকের মতে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা কারবার করে বা বহন করে ভুঁইফোঁড় ব্যক্তিরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহকারী, চাকুরীরত কর্মচারী, কর্মকর্তা,কনস্ট্রাকশন ফার্মের সাথে জড়িত ব্যক্তিরাসহ পুরনো ব্যবসায়ীরা ! এসব হাজার হাজার ইয়াবার যোগান দাতা হিসেবে রোহিঙ্গা জনগোষ্টির কথা উঠে এসেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্টির সাথে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগসাজসে ইয়াবা কারবারীর একটা শক্ত নেটওয়ার্ক সৃষ্টি হয়েছে বলে কথিত আছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে অর্থলগ্নী করে ইয়াবা বানিজ্য চালু রেখে, সেই বাণিজ্যের একটা কমিশন বা মার্জিন প্রভাবশালীদের হাতে অটো চলে যাবার খবরও পাওয়া যায়। এসব তথাকথিত নেতারা, চোরাকারবারীদের বিভিন্ন বিপদে-আপদে জনপ্রতিনিধি, নেতা বা নের্তৃ হিসেবে রক্ষাকবচের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু তারা নিজেরা আইনী জটিলতার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন সবসময় ! এসব নতুন ও পুরণো কারবারীরা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে রাতারাতি কোটি কোটিপতি হয়ে যাবার খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে তারা আপাততঃ ব্যবসার সাথে সম্পর্ক গুটিয়ে নিয়ে বৈধ-অবৈধ ব্যবসার আড়ালে নিজকে সাধু সেজে বসে আছেন পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় ! এই অসাধু বেপারীদের তোপে মুখে হক হালালী, বৈধ আয়ের মানুষগুলো সমাজে আয় বৈষম্যের শিকার হয়ে নিদারুন কষ্টে কালাতিপাত করছেন। কিন্তু তাঁরা ভিতরে কষ্ট ভোগ করলেও প্রকাশ করছেন না, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন !

প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন-এসব অপকর্ম,দেশদ্রোহী কাজ, অমানবিক কার্যাবলীর সাথে কারা কারা জড়িত ছিল বা আছেন। কারা কারা পৃষ্টপোষকতা দিচ্ছেন, কারা অর্থলগ্নী করছে্ন, কারা সরাসরি জড়িতদের সাহায্য সহযোগিতা করছেন, কারা অন্তরালে বেনিফিসিয়ারী হচ্ছে্ন, কাদের ছত্রছায়ায় মাদক, অপহরণ, গুম-খুনসহ দূর্নীতির ভয়াল বিস্তার ঘটছে! অনেক সময় ‘শষ্যের ভিতরে ভূত’ থেকে যায়। তাই ভূত তাড়ানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে! আবার অনেক আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য রাতারাতি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক বনে যাবার অদম্য বাসনায়, অতি লোভের বশবর্তী হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে, অপরাধীদের সাথে আতাঁত করছে, ক্রস ফায়ার, গুম বা খুনের ভয় দেখিয়ে সাধারন মানুষকে হয়রানী করে, চাপের মুখে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার খবরও পাওয়া গেছে।

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উখিয়া টেকনাফ মাদক ও অন্যান্য চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য বলে কুখ্যাতি রয়ে গেছে বরাবরই। অনেকের মতে, সীমান্ত উন্মুক্ত ও অরক্ষিত রেখে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত মাদক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কতটুকু কার্যকর ও সফলতা পাবে তা বলাই বাহুল্য! মনে কৌতুহলী প্রশ্ন জাগে, উখিয়া টেকনাফে ইয়াবা বন্ধের দায়িত্ব কি শুধুই পুলিশের? যদি না হয় তাহলে সীমান্তে পাহারায় বিজিবি, পানিতে কোস্টগার্ড, স্থলে র‍্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর ও অন্যান্য বাহিনীর ভূমিকা কি ও কতটুকু? এসব প্রশ্নের নানা উত্তরও খুঁজে জনগণ। উত্তরে যাই আসুক তবে তদন্ত পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। রাষ্ট্রে বসবাস করলে রাষ্ট্রের আইন মানতে হয় বৈকি !

পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্যমতে, ৬১ কিলোমিটারের আন্তর্জাতিক নাফ নদী বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তকে বিভক্ত করে রেখেছে। কয়েক বছর আগে নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে (রাখাইন রাজ্যে) কাঁটাতারের বেড়া ও সীমান্ত সড়ক তৈরি করেছে মিয়ানমার। এরপরও নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ১৮টি অরক্ষিত সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার বড় চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। প্রতিবছর ইয়াবা বিক্রির বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে। মাঝেমধ্যে অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনাও ঘটছে। অনেকেই মনে করেন ও বিশ্বাস করেন, সীমান্ত সড়কটি নির্মিত হলে মাদক-অস্ত্র চোরাচালান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশসহ সীমান্তের সব অপরাধ দমনে বিজিবি জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে। বাড়বে সীমান্ত নিরাপত্তাও। বিশেষ করে বিজিবির টহল জোরদার হলে স্থানীয় ১০ হাজার জেলে নাফ নদীতে মাছ ধরার নিরাপত্তা পাবে।

আইন শৃংখলা বাহিনী যদি সত্যিকার অর্থে মনপ্রাণ দিয়ে মাদক ও দূর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন এবং দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের কাজে কোন প্রকার বাধাগ্রস্থ না করেন এবং তাদেরকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন-তাহলে মাদক ও দূর্নীতি দমন করা তাদের জন্য কোন ব্যাপারই নয়! দেশ থেকে মাদক ও দূর্নীতি দূর করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘মাদক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করা সময়ের অপেক্ষা মাত্র! কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনী যেমন উদাসীন, তেমনি তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপের কারনে সত্যিকারের দেশ সেবায় মনোনিবেশ করতে পারেননা। যতদিন পর্যন্ত না চোরাচালানের সীমান্ত পথ বন্ধ করে অবাধ যাতায়াত বন্ধ করা যাবেনা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অনধিকার প্রবেশ রোধ করা যাবে না, আইন শৃংখলা বাহিনী, সরকারী বিভিন্ন সংস্থার মাঠ পর্যায়ের সদস্য, কর্মকর্তা, কর্মচারী, এ সকল অপরাধ থেকে নিজদের সম্পৃক্ততা বন্ধ করতে পারবেননা এবং সাধারন জনগনকে সচেতনতা বৃদ্ধি করাতে পারবেননা, মাদক ও দূর্নীতির নেটওয়ার্ক গুড়িয়ে দিতে পারবেননা এবং বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা অপরাধ দমনে এগিয়ে আসবেন না, ততদিন মাদক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের বিজয় অর্জন করা কখনই সম্ভবপর হয়ে উঠবেনা।

বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত মাদক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সফল করার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আইন শৃংখলা বাহিনী, বিজিবি, কোষ্ট গার্ড, বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, সংস্থাসহ সরকারী বাহিনীগুলোকে সৎ, সাহসী, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ন ও সর্বোপরি পেশাদারিত্বের মনমানসিকতাসম্পন্ন হয়ে দেশ ও মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আইন শৃংখলা বাহিনী, মাদক প্রতিরোধের বিভিন্ন সংস্থা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরে সারা দেশের চোরাকারবারী, দূর্নীতিবাজদের একাধিক লিষ্ট রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সরকারী বিভিন্ন মাদক প্রতিরোধী বাহিনীসহ আইন শৃংখলাবাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মরত সদস্যরা জানেন কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, কারা কারা জড়িত, কারা মাদক প্রসারের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছেন, কারা কোন পথে কিভাবে মাদক ও অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত, কারা মুল হোতা, কারা ইনফরমার, বাহক, ট্রেডারস, কারা অর্থলগ্মীকারক অথবা বিভিন্ন মাদক ও অন্যান্য অবৈধ কারবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

পরিশেষ বলতে চাই, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার সময় আমরা মানবিক পুলিশকে কাছ থেকে দেখেছি। পুলিশ শুধু পুলিশ নন, একজন মানুষও বটে। মানুষ ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। তাই সব পুলিশ বা আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য নূরের তৈরি ফেরেস্তা যেমন নয়, তেমনি আগুনের তৈরি শয়তানও নয়। তারা মাটির তৈরী রক্তমাংসে গড়া এই গ্রহেরই মানুষ। আমাদের মতই মহান আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব। তাই তাদের মানুষের মতই ভুল থাকবে, ভালো-মন্দ থাকবে, দোষ-ত্রুটি থাকবে আবার সততা, মানবিকতাও থাকবে তা স্বাভাবিক। ফেরেস্তাদের কাছে আমরা ভুল যেমন আশা করি না , ঠিক তেমনি শয়তানের কাছেও আমরা ভালো কিছু, আশা জাগানিয়া তেমন কিছু আশা করি না! সুতরাং ভুল আর ভালো মিলেমিশেই মানুষ। যার সবকিছু আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকি। আমরা এক ওসির ভুল পথে যাওয়া অপরাধ অন্যের ঘাড়ে যেমন চাপাতে পারি না, ঠিক তেমনি দোষ দিতে পারি না সব পুলিশ বাহিনীর সদস্যদেরকে !

(লেখক: সাংবাদিক, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী)