মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন বিরোধ, জাতীয় নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশঃ একটি পর্যালোচনা।

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪

 

🖋️ এম আর আয়াজ রবি ।।

স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে, গত প্রায় ৬ বছর ধরে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সবচেয়ে কঠিন সংকট মোকাবেলা করছে প্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ । সেই সংকটের নাম মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত আমাদের দেশের আশ্রিত রোহিঙ্গা জন গোষ্টীর সংকট, যাকে বলা হয় ‘রোহিঙ্গা সংকট’। তবে ইদানিং, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান বিরোধ তুঙ্গে। এই বিরোধের রেশ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এর সদস্যরা দফায় দফায় পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় প্রার্থনা করে, অস্ত্র সমর্পণ করেছেন।আবারো রোহিঙ্গা ঢলের আশংকা রয়েছে। সীমান্তের ওপারে প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের প্রহর গুনছে বলে বিভিন্ন খবরে চাউর হয়ে আছে। কিন্ত আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’র কড়া নজরদারীতে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল থামানো গেলেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যাবে কিনা তা এক কঠিন কাজ বলে মনে হচ্ছে।

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং আরাকান আর্মি’র—সমন্বয়ে গঠিত ‘ব্রাদারহুড অ্যালাইয়েন্স’র ‘অপারেশন ১০২৭’ কাছে মিয়ানমারের মহাপরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর নিয়মিত পরাজয়ের খবর আমরা পাচ্ছি। বিশেষ করে, আরাকান আর্মি একটার পর একটা মিয়ানমারের মিলিটারি ঘাঁটি দখল করে নিচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যায়, আরাকান আর্মি ১৩ নভেম্বর রাখাইনে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করার পর সিতওয়ে’র নিকটবর্তী পাউকতাও শহর এবং চিন প্রদেশের পালেতাওয়া শহর সহ ১৬০টি অবস্থান থেকে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীকে উতকাত করে।এরই ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন ও আরাকান রাজ্যেও যুদ্ধ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

অন্যদিকে,গত ছয় বছর পুর্বে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা সংকটের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও এ সংকটে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়েছে আরও আগে, ১৯৭৮ সাল থেকে। কথায় আছে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের ১০ ফোঁড়ের সমান। বাংলাদেশের বিগত সব সরকারই সমস্যাটি আজকে যে রূপলাভ করেছে তার পূর্বানুমান/ অনুধাবন করতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে ঠিক তেমনি সময়োপযোগী বাস্তব কোন ব্যবস্থা নিতেও ব্যর্থ হয়েছেন। দীর্ঘদিন যাবৎ বিশাল সংখ্যক বলতে গেলে হিসাববিহীন রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে, তা বাংলাদেশের জন্য এক প্রকার বিষফোঁড়ার মতো হয়ে আছে । কারন এ সমাস্যা এখন স্রেফ দ্বি-পাক্ষিক বিষয় নয়, বহুপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিকও বটে! উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি পর্যায়ের অনেকবার বৈঠক অনুষ্টিত হয়েছে কিন্তু তাতে কোনো কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকে তাদের স্বদেশে প্রত্যবর্তন করানো/পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং মিয়ানমানের অভ্যন্তরীন বিবাদ, অস্থিতিশীলতা ও বিভিন্ন অজুহাতে অনানুষ্টানিকভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাটির শুরু সেই ১৯৪৮ সাল থেকে এবং এর ঐতিহাসিক লেগেছি আরও পুরনো। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর এর চাপ আজ যেভাবে এসে পড়েছে তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে ১৯৭৮ থেকে ২০১৭ সময়ে, গত ৩৮ বছরে। রোহিঙ্গারা এসেছে, আমরাও আশ্রয় দিয়েছি। আবার মিয়ানমার সরকারও ভেবেছে একটু ভালো করে তাড়া দিলেই রোহিঙ্গারা সব বাংলাদেশে চলে যাবে, বাংলাদেশের বর্ডার তাদের জন্য উন্মুক্ত। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং আরাকান রাজ্য নিয়েও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশই হচ্ছে রোহিঙ্গাদেরকে বাস্তুচ্যুত করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে ঠেলে দেওয়া।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একেক সরকার একেক রকম রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করায় এবং মায়ানমান সরকারের অনড় নীতির কারনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং মিয়ানমার সরকার, দুই পক্ষই রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সঠিক অবস্থান বুঝতে এবং সুন্দর একটা সমাধানের পথ বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য আমরাও খুব ভাল ভাবে ইস্যুটি হ্যান্ডেল করতে পারিনি। যদিওবা বিষয়টি একান্তই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু কিন্তু এখন আমাদের গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার ব্যথা দিচ্ছে প্রতি পদে পদে।

১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথমবার ( ১৯৯০-৯১ সালে দ্বিতীয়বার) আরাকান থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যাত্রা কিন্তু তখনই শুরু। ওই সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল সামরিক সরকার। অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন তখনকার সামরিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিস্থিতির দূর দৃষ্টিসম্পন্ন পর্যবেক্ষন ও মূল্যায়নে ব্যর্থ হওয়ায় স্থায়ীভাবে এ সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ে। তখন সমস্যাটিকে ধর্মীয়করণ এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করায় বাংলাদেশের জন্য সেটি হিতে বিপরীত হয়েছে। অনেকেই অবশ্য ভিন্ন কথাও বলার চেষ্টা করেছেন। (ভিন্নমতাবলম্বীদের মতে, তখনকার সামরিক সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধান করতে পেরেছিলেন, যা এখন লেজে গোবরে অবস্থা হয়ে গেছে )। এতে রোহিঙ্গারা ভেবেছে বাংলাদেশ তাদের জন্য সহজ আশ্রয়স্থল। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারের মনে হয়তো বহু রকমের সন্দেহবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ে দুই-আড়াই লাখের মতো ফেরত গেলেও আরও প্রায় দুই-আড়াই লাখ কক্সবাজার অঞ্চলে রয়ে যায়। তারপর বিক্ষিপ্তভাবে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। তাতে বলা যায় নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় এসে বসতি গড়ে তোলে। ১৯৭৮ সাল থেকে আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে বিভিন্নভাবে স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে মায়ানমার সংখ্যাগুরু জনগন ও শাসকগোষ্টি।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী ও স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের চলমান সংঘর্ষের উত্তাপ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এর সদস্যরা দফায় দফায় পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় প্রার্থনা করে, আত্মসমর্পণ করেছেন। এ পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রায় ৩৩০ জন সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী ( বিজিপি)’র সদস্য অস্ত্রশস্ত্রসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, ঘুংধুম, উখিয়ার পালংখালীর রহমতের বিল ও আণজুমের পাড়া এবং টেকনাফের হোয়াইক্যং ও হ্নীলা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং অস্ত্রসমর্পণ করেছে।

এর বিপরীতে ফিরে দেখা সেই ২০১৫ সালের ১৭ জুন তারিখ। সেদিন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হাতে টেকনাফে টহলরত অবস্থায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আব্দুর রাজ্জাককে অপহরণ করেছিল মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। অপহরণের পর নির্যাতনের ৯ দিন পর বৃহস্পতিবার তাকে বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

বিজিবি সূত্রমতে, নায়েক রাজ্জাকের নেতৃত্বে বিজিবির ছয় সদস্যের একটি দল সেদিন মধ্যরাতে নাফ নদীতে টহলকালে মিয়ানমারের রইগ্যাদং ক্যাম্পের বিজিপির একটি দল ট্রলারে করে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। একপর্যায়ে টহল দলটি বিজিবির নৌযানের কাছে গিয়ে থামে। বিজিপির ট্রলারটিকে বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে যেতে বলা হলে তারা নায়েক রাজ্জাককে জোর করে ট্রলারে তুলে নেয়। এ সময় বিজিবির অন্য সদস্যরা বাঁধা দিলে দুইপক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এতে বিজিবির সিপাহি বিপ্লব কুমার গুলিবিদ্ধ হন। এরপর বিজিপির ট্রলারটি রাজ্জাককে নিয়ে মিয়ানমারের দিকে চলে যায়। বিপ্লবকে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিজিবি বলছে, আটক রাজ্জাককে ফেরত চেয়ে কয়েক দিন ধরেই যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে, ২০১৪ সালের ২৮ মে বান্দরবানের পানছড়ি সীমান্তে কোন রকম উস্কানি ছাড়াই বিজিবির সদস্যদের ওপর গুলি চালায় মিয়ানমারের বিজিপি। সে সময় নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায় তারা। পরে তাকে হত্যা করা হয়। অবশ্য ওই ঘটনায় দু’দিন সীমান্তে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নায়েক মিজানুর রহমানের লাশ হস্তান্তর করে বিজিপি। এবারের ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৬ জুন-২০১৫ রাতে।

উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে বলা যায়, মিয়ানমারের একঘেয়েমি, বর্বরোচিত ঘটনার বিপরীতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী ( বিজিপি)কে অস্ত্রশস্ত্রসহ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে সুযোগ এবং তাদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করে নজির স্থাপন করেছে বলা যায়।

আন্তঃসীমান্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহুবার বিঘ্নিত হয়েছে। কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশের আনসার ক্যাম্প থেকেও একদল সন্ত্রাসী অস্ত্র লুট করেছিল ২০১৬ সালের ১২ মে। তাতে আনসার কমান্ডার আলী হোসেন নিহত হন। বাংলাদেশের সরকার এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক সরকার তা গ্রহণ না করে উল্টোপথে হেঁটেছেন বার বার। মিয়ানমারের সব ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ বাংলাদেশ-মিয়ানমার বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রায় শতভাগ দূর করা সম্ভব তা তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তাজনিত সংকট ভারত-বাংলাদেশ এক হয়ে সমাধানের মাধ্যমে। মিয়ানমার এ পথে হাঁটলে নিরাপত্তাজনিত সমস্যাও দূর হতো এবং একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যারও একটা স্থায়ী সমাধান হয়ে যেত।

জাতিগত নিধন, গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যা মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্টির উপর করেনি । চীন তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় এক রকম অন্ধভাবে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। সব মানবতাকে দক্ষিন চীন সাগরে বিসর্জন দিয়েছে। বাংলাদেশ দ্বি-পক্ষীয়, বহুপক্ষীয়সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সব ফ্রন্টে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার আগের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এলেও খুব সহসা তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে তেমন কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। মিয়ানমারের আন্তরিকতা ও আগ্রহ সম্পর্কে সবারই প্রশ্ন আছে। তাই সঙ্গত কারণেই সবাই বলছেন সমস্যার সমাধান সহজে হচ্ছে না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশকে একটা নাতিদীর্ঘ সময় প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা টানতে হতে পারে। সমাধানের পথ দীর্ঘ হলে এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বর্তমানের মতো একই মাত্রায় অ্যাক্টিভ রাখা আগামীতে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে ১৪ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে অর্ধেকই শিশু-কিশোর। এরা তো বড় হবে। ক্ষোভ, হতাশা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার জায়গা থেকে এর একটা স্বল্প সংখ্যাও যদি সন্ত্রাস এবং বিদ্রোহের পথ বেছে নেয় তাহলে সেটা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য ভীষণ বিপজ্জনক হবে। মিয়ানমার তো নয়ই, চীন, ভারত কেউ এ বিপদের বাইরে থাকতে পারবে না। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভারত ও চীনের সব স্বার্থ অনবরত হুমকির মধ্যে থাকবে।

সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গাটি হলো, রোহিঙ্গাকে সমস্যাটি এখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির জন্য এ অঞ্চলে প্রভাব বলয় বিস্তারে দাবার ঘুটিতে পরিণত হওয়ায় মিয়ানমার সরকার এক বৃহৎ রাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন পাচ্ছে। আবার ভূ-রাজনীতির কারনে অন্যদিকে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতও মায়ানমারের পক্ষ্যেই অনঢ় রয়েছে অনেকাংশে। তাই বাংলাদেশকে সুদূরপ্রসারী চিন্তা এবং সংকটের ভবিষ্যতে রূপরেখা সম্পর্কে আগাম বিচার বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এখানে একটা কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি, পুর্বে যেসব রোহিঙ্গা এদেশে এসে নাগরিকত্ব সনদ গ্রহন করেছে তারাই কিন্তু এদেশটাকে ধ্বংশ করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে অতি মাত্রায়! ঐসব তথাকথিত নাগরিকত্ব প্রাপ্ত রোহিঙ্গারা অধুনা আগত রোহিঙ্গাদেরকে বিভিন্নভাবে পথ প্রদর্শন, তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা ও বিভিন্নভাবে আশা-ভরসা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের জন্য আমাদের এলাকায় বনভুমি উজাড় করে, পাহাড় পর্বত বিলীন করে বসতি স্থাপন করে দিয়ে অত্র অঞ্চলের পরিবেশ প্রতিবেশের ভয়ানক ক্ষতি সাধন করেছে, ক্ষতি হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। তাছাড়া রোহিঙ্গারা সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন রকমের চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, খুন খারাবীসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসীমূলক কার্যকলাপে স্থানীয় বাসিন্দাদেরসহ পুরো বাংলাদেশকে আজ জিম্মি করে রেখেছে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দ্ধারা।

তাছাড়া বিভিন্ন এনজিও, আইএনজিও সহ বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্টান তাদের সাথে অনেক ক্ষেত্রে আঁতাত করে বেসরকারী প্রতিষ্টানের একচেটিয়া ততপরতা ধরে ও টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরোদ্ধ আচরনে লিপ্ত থেকেছে। এই সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে বাংলাদেশের আইন শৃংখলা বাহিনীর গর্বিত সদস্য পুলিশ, বিজিবি,সেনাবাহিনী দিয়েও নিয়ন্ত্রন করা কঠিন নয় রীতিমত অসাধ্য হয়ে পড়েছে। এই সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের রক্তে,মাংসে, মজ্জায় ও শিরা উপ-শিরায় হিংস্রতা,বর্বরতা, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, খুন-খারাবি, রাহাজানী, নারী ধর্ষন, গুম, মুক্তিপণ আদায় প্রভৃতি মিশে আছে নিজেদেরও অজান্তে, যা এখন তাদের নিত্য দিনের কাজ মাত্র। কারন তারা এসব অপকর্ম ও রক্তপাত দেখে শিখে বা করে করে বড় হয়েছে মায়ানমারের একনায়ক সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে!
ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। দেশীয় আইন, কানুন, নিয়ম নীতি চলে শুধু লোক দেখানো। এখানে বিদেশী এনজিও গুলোর চলে একক আধিপত্য। দেশি বিদেশি এনজিও ও রোহিঙ্গারা মিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিজেদের তৈরি করা নিজস্ব আইন বিদ্যমান রেখেছে। রাতের বেলায় পুরো ক্যাম্প এলাকা তাদের জিম্মায় থাকে। বাংলাদেশের কোন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রাতের বেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে যাবার সাহসও করেনা।ক্যাম্পের ভিতরে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নের্তৃত্ব গড়ে তোলা হয়েছে। এক এক শেডে কয়েকজনের গ্রুপে একটা নের্তৃত্বে চলে। রাতের অন্ধকারে ঐসব রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় এমন কোন অপরাধমূলক কাজ নেই তারা করেনা। সেখানে নিজেদের মধ্যে অস্ত্রের প্রশিক্ষন চলে নির্ভয়ে, চলে রীতিমত মাদকের আখড়া, নারীবাজী, নেশাবাজীসহ অপরাধ সংঘটিত করার বিভিন্ন কলা-কৌশল।
পাশের পাহাড়ে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসীদের অভয়ারন্য। ক্যাম্পের ভিতরে বসে রীতিমত নেশা ও মাদকের আস্তানা। মাঝে মধ্যে আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে (ক্যাম্পের ভিতরে ও বাইরে) সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারীদের বন্দুক যুদ্ধের খবরা খবর পত্র প্ত্রিকায় চোখে পড়ে। পত্র পত্রিকায় যেসব খবর আসে তা মুল খবরের কিয়দংশ মাত্র। আসল অনেক খবর অগোচরে রয়ে যায় জনমের মত।বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত মাদক ও দূর্নীতির বিরোদ্ধে জিরো টলারেন্স, এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে বড় রকমের হোঁচট খেয়েছে। মাদকের থাবা এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এভাবে বিস্তৃত যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনাকেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে তুলেছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সাথে আঁতাত করা স্থানীয়, দেশি-বিদেশি দুর্বত্তরা!

স্থানীয় জনগোষ্টীর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন বৈধ ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ইয়াবা কারবারের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে পড়েছে। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাওয়ার বাসনায় ও শর্টকাট ম্যাথডে কোটিপতি হওয়ার মানসিকতায় স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও স্বার্থান্বেসী লোক এই মরন নেশা ইয়াবা কারবারীতে জড়িয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্টী ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যৌথভাবে এসব মরন খেলায় আইন শৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে (অনেকে বলেন, এক প্রকার আঁতাত করে) এসব অপকর্ম করে চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় লোকদের ধরে নিয়ে মুক্তি পণ আদায় করছে, দিনে ও রাতে ডাকাতি, অপহরণ, পণ আদায়, মুক্তিপণ না পেলে খুন করা, জাহাজে করে মানুষকে মালেশিয়া নিয়ে যাবার কথা বলে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে নৌকায় তুলে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে, পরে তাদেরকে মারধর করে আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে পণ গ্রহন ইত্যকার ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটাচ্ছে এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। অনেক স্বার্থান্বেষী স্থানীয় লোক রোহিঙ্গাদের সাথে মিশে ঐসব অপকর্ম করে চলেছে বলে বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, তাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও একতা গড়ে তোলা হয়েছে অত্যন্ত সু-কৌশলে। তাদের একতা ও ঐক্য এমন ইস্পাত কঠিন, এদেশের আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে রীতিমত বিবাদ তৈরি করে পুলিশ, বিজিবি, আর্মির সাথেও তারা মুখোমুখি হতে বিন্ধু পরিমান ভয় পায়না এমনকি পরোয়াও করেনা ! মাঝে মাঝে অনেক ছোট খাট ব্যাপারেও তারা আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের একতা, ঐক্য ও শক্তি সামর্থ্য দেখাতে-ইচ্ছে করেই এরুপ কার্যকলাপ করে বলে অনেকেই মনে করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে বিভিন্ন গ্রুপ, উপ গ্রুপে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে, তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্র। রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন সন্ত্রাসী সঙ্ঘঠনের সাথে লেজুড়ভিত্তি। অনেক যোদ্ধা অস্ত্র শস্ত্রের ট্রেনিং গ্রহনের জন্য বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে চলে যায়, দেশে এসে অন্যান্য গ্রুপ্দের প্রশিক্ষন প্রদান করে পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্টি রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরোদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের দামামা বাজানোর জন্য সদা সর্বদা প্রস্তুত। অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অলিখিত তাদের শাসনে চলে যেখানে আইন শৃংখলা বাহিনী দেশি ও বিদেশী ষড়যন্ত্রের কাছে নিরুপায় ও অসহায় আত্বসমর্পন করে। আন্তর্জাতিক এন জিওগুলোর প্রশাসনের অধীনে চলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো, তখন আমাদের আইন শৃংখলা বাহিনীর কিছু করার থাকেনা। তারা অসহায় হয়ে তাদের কথা মেনে চলতে বাধ্য হয় অনেক ক্ষেত্রে।
মায়ানমারের বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্টি যারা আমাদের উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন অঞ্চলে/ক্যাম্পে অবস্থান করছেন । প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য একটা সংকট ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু বর্তমানে এটি সংকট থেকে মহা সংকটে রুপান্তর হতে চলেছে ধীরে ধীরে। এটা অনেকেই গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়া বলে মনে করছেন। রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য একটি গভীরতর উদ্বেগের বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে।

উদ্বেগের আরও কারণ হচ্ছে, যদি রাখাইনে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং রাখাইনে যদি একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তখন রাখাইনে বসবাসকারী প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার জোর চেষ্টা করবে।

তখন রোহিঙ্গাদের এই নতুন অনুপ্রবেশ ঠেকানো বাংলাদেশের জন্য একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি কোনো কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে আরাকান আর্মির পরাজয় ঘটে (সেই সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না), তখনো আরাকান আর্মির প্রতি সমর্থন থাকার কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নতুন করে দমনপীড়ন চালাবে। তখন রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গারা নিজেদের ‘প্রাণ’ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করবে।

আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এই রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে আজ না হয় কাল, তাদের স্বদেশে ফেরত যেতে বাধ্য করে এই ‘ভয়ংকর জগাদ্দল পাথর’ আমাদের ঘাড় থেকে সরাবার পথ প্রশস্ত হবে। যদি কোন কারনে তা দীর্ঘায়িত হয়,তা আমাদের জন্য গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়ে বড় ব্যথার কারন হবে নিশ্চয়ই। অনেকেই মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যের ‘ক্যান্সার খ্যাত’ ইসরাইল রাষ্ট্রের উভ্যূদয়ের মত মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্টিও আমাদের দেশে ‘ক্যান্সার’ জীবানু ছড়িয়ে আমাদের স্বকীয়তা, জাতিসত্ত্বা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

(লেখক: কলামিস্ট, পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী)