উখিয়ায় দু’সপ্তাহের ব্যবধানে অবৈধ পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটি চাপায় ২ জন নিহত, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪

 

।। এম আর আয়াজ রবি।।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে রাতের অন্ধকারে ও দিন-দুপুরে প্রাকৃতিক পেরেক খ্যাত টিলা, উপত্যকা ও বিভিন্ন পাহাড়সমুহ কেটে উজাড় করে দিচ্ছে এক শ্রেণির পাহাড় খেকো ভুমিদস্যুরা। ফলে পরিবেশের যেমন বিপর্যয় ঘটছে তেমনি বনভুমি ও বন্যপ্রাণির অস্তিত্বের উপর আঘাত আসছে চরমভাবে। জলবায়ু ও ইকোসিস্টেমে পড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের মারাত্মক অশনি সংকেত। যার ফলে প্রকৃতি তার আপন ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এমনিতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এ এলাকার পাহাড় ও বনভুমির উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারনে প্রকৃতির রক্ষাকবচ পাহাড় ও বনভুমির উপর পড়ছে নিয়ন্ত্রনহীন চাপ, ফলে ঘটছে জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়।

বেশিরভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমূহ উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য প্রায় ১০ হাজার একর বনভুমি, পাহাড় ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে, পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জৈব-বৈচিত্রের উপর নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যেও বনভুমি, পাহাড়, নদী-নালা, খাল বিলের দখল থেমে নেই। প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে দেদারসে পাহাড় ও বনভুমি ধ্বংসের মহোৎসব চলছে। দু’সপ্তাহের ব্যবধানে পাহাড় কাটতে গিয়ে দুটি তাজা প্রাণ যে ঝরে গেল, তার দায়ভার কে বহন করবে? তাদের পরিবারের দায় ভার কে নেবে?

গত শনিবার (২০-জানুয়ারী-২০২৪) সকাল সাড়ে ৫ টার দিকে অবৈধভাবে পাহাড় কাটতে গিয়ে জালিয়া পালং ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের পাইন্যাশিয়া চাককাটা গ্রামের জনৈক নুরুল ইসলামের ছেলে মুসলেহ উদ্দিন মাটি চাপায় নিহত হয়।

অন্যদিকে, গত শুক্রবার ( ২-ফেব্রুয়ারী) সকাল সাড়ে ৫ টার দিকে উখিয়া থানাধীন ৩নং হলুদিয়া পালং ইউপিস্থ পশ্চিম মরিচ্যা ঢালার মুখ জনৈক দেলোয়ার এর পোল্ট্রি ফার্ম এর পশ্চিমে বন বিভাগের পাহাড় এলাকায় পাহাড়ের মাটি কাটার সময়, মাটির নিচে চাপা পড়ে মৃত আবুল কালামের পুত্র মোহাম্মদ আলম নামের এক রোহিঙ্গা শ্রমিক নিহত হয়েছে।

উখিয়া থানা পুলিশ সুত্রে জানা যায়, ২০ জানুয়ারি -২০২৪ এর প্রথম ঘটনায় ‘ভিক্টিম স্হানীয় হেলাল কোম্পানীর ডাম্পার ট্রাকে মাটি কাটতে গেলে হঠাৎ করে বড় একটি মাটির চাক ও গাছের ধারালো শিকড় ভিকটিমের গোপন অঙ্গের অণ্ডকোষের পাশে ডুকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে গুরুতর আহত হয়, সাথে থাকা লেবার’রা ভিকটিম কে উদ্ধার করে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে ২-ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় ঘটনায়, ভিকটিম মোহাম্মদ আলম(২৮) একজন রোহিঙ্গা সদস্য। সেদিন শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টার দিকে, উখিয়া থানাধীন ৩নং হলুদিয়া পালং ইউপিস্থ পশ্চিম মরিচ্যা ঢালার মুখ জনৈক দেলোয়ার এর বাড়ির পাশে বন বিভাগের পাহাড় কাটার জন্য নিয়োজিত হয়। পাহাড়ের মাটি কাটার সময় মাটির বড় একটি চাক ভিকটিমের উপরে পড়লে চোখের ভ্রু এর উপর হয়ে পেটের উপর চাপা পড়ে মলদ্বার দিয়ে পেটের ভুড়ি বের হযে যায় এবং ডান পায়ের গোড়ালীর হাড় ভেঙ্গে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।থানা পুলিশ সংবাদ পাইয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া সুরতহাল করেন। উপরোক্ত দুটি মর্মান্তিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, উখিয়ায় পাহাড়খেকো সিন্ডিকেট প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এক প্রকার ম্যানেজ করেই নির্বিচারে পাহাড় কেটে উজাড় করে চলছে।

কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত পাহাড় কাটা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এলাকার প্রভাবশালী ও অবস্থা সম্পন্ন পরিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে পুঁজি করে দোকান ঘর, বাসাবাড়ী, অফিস ঘর তৈরির নামে প্রাকৃতিক পাহাড় নিধন করে, সমতল ভুমি ভরাট করে প্রাকৃতিক পেরেকখ্যাত পাহাড়কে বিনষ্ট করে সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি করে এতদ অঞ্চলকে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ে মুখোমুখি করে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে বসবাসের অযোগ্য করে গড়ে তোলার হীন প্রচেষ্টায় রত আছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগামী দশকের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার এক দশমাংশ ভুমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। সেই আশংকাকে বাস্তবে রুপদান করার কাজে এসব পাহাড় খেকো সিন্ডিকেট সম্পৃক্ত হয়ে দেশদ্রোহী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ফলে, এসব পাহাড় ও বনভুমি রক্ষাকল্পে আইনানুগ ব্যবস্থা ও শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন করা এখন সময়ের একান্ত বড় দাবি।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন-১৯৯৫ (২০০০ সালে সংশোধিত) এর ১ নং ধারার ৬(খ) উপধারায়, পাহাড় কাটা সম্পর্কে বাধানিষেধ অপশনে বলাহয়েছে-“ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান কর্তৃক সরকারী বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্ত্ব শাসিত প্রতিষ্টানের মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন, বা মোচন ( ) করা যাইবেনা। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদফতরের ছাড় পত্র গ্রহণক্রমে কোন পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইত পারে“।

উক্ত আইনে প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষতির ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যাপারে ১ নং ধারায় ৭(১) উপধারায় বলাহয়েছে, “ মহাপরিচালকের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, কোন ব্যক্তির কাজ করা না করা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবেশ ব্যবস্থা বা কোন ব্যক্তি বা গোষ্টির ক্ষতিসাধন করিতেছে বা করিয়াছে, তাহা হইলে তিনি উক্ত ক্ষতির পরিমান নির্ধারন পুর্বক উহা পরিশোধ এবং যথাযথ ক্ষেত্রে সংশোধনমুলক ব্যবস্থা গ্রহন বা উভয় প্রকার ব্যবস্থা গ্রহনে জন্য নির্দেশ দিতে পারিবেন এবং উক্ত ব্যক্তি উক্ত নির্দেশনা পালনে বাধ্য থাকিবেন”।

এলাকারসচেতন মহল প্রচলিত আইনের বাস্তব প্রয়োগ করে, পাহাড় খেকো সিন্ডিকেট চক্রেরবিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্হা গ্রহনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন সংরক্ষক, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মহোদয় ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
[লেখক: কলামিস্ট ও সভাপতি-বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
উখিয়া উপজেলা।]