গ্যাসের দাম বাড়ানো গ্রহনযোগ্য নয় –রুহিন হোসেন প্রিন্স

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২

বিশেষ প্রতিবেদক ;

বেঁচে থাকতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল সাধারণ মানুষ। একের পর এক অসহনীয়, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির কথা বলতে,মৃল্যবৃদ্ধি করতে শাসকদের কোন কার্পণ্য নেই। বরং নির্লজ্বের মত অযৌক্তিক কথা-বার্ত বলে এইসব মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির, দাম বাড়ানোর প্রচেষ্টা ও শাসকদের কথাবার্তায় দেশবাসী এসব ঘটনা দেখছে। দেশসহ সারা বিশ্ব করোনা মহামারির সংকট অতিক্রম করছে। সরকারি হিসেবে করোনার প্রথম ধাপেই প্রায় দুই কোটি মানুষের আয় কমেছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে। পরের ধাপে সোয়া তিন কোটি মানুষের আয় কমেছে। এই সময় যে কোন দায়িত্বশীল সরকারের কাজ হওয়া দরকার ছিল মানুষের খরচ কমানোর ব্যবস্থা করা। আয় কমে যাওয়া এসব মানুষকে সরাসরি প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা।এসব না করে সরকার তার গণবিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার সব পথ বাস্তবায়নের পথ বেছে নিচ্ছে। এ যেন আখের ছোবড়া নিংড়ে নেওয়া।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারের এই চেহারাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। দেশীয় গ্যাস কোম্পানীগুলো গ্যাসের দাম দ্বিগুণেরও বেশী প্রস্তাব করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)তে পাঠিয়েছে। বিইআরসি হয়তো একটু লজ্জা পেয়ে পুনঃপ্রস্তাব করতে বলেছে। গণগুনানী করে যুক্তিতর্ক শুনে, দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করে বিইআরসি’র এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। অবশ্য ইতোমধ্যে দেশবাসী জেনে গেছেন, বিইআরসি সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়। গণশুনানীর নামে এটি গণনাটক হয়েই থাকে। এটির প্রমাণ আবারও মিলল সম্প্রতি জ্বানানী প্রতিমন্ত্রীর কথায়। তিনি এখনই বলে দিলেন,“…অসন্তোষ না হয়, তা বিবেচনা করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কাজ চলছে।”এই মন্ত্রীই ক’দিন আগে তিতাস গ্যাস কার্যালয় যেয়ে অব্যবস্থাপনা,অপচয় ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেন। অথচ এসব পরিবর্তনে কোন উদ্যোগ নেই। নিয়মিত বিল দিয়ে রাজধানীর অনেক এলাকায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। অনেক এলাকায় যে কোনভাবে লাইন নিয়ে মানুষের প্রতি মাসে বিল দিচ্ছে। অথচ ঐ টাকা সরকারি খাতে জমা হচ্ছে না।যাচ্ছে গ্যাস কোম্পানীর লুটপাটকারী ও স্থানীয় দালালদের পকেটে।
এইা সবাই বোঝে, গ্যাসের দাম বাড়লে, বাসা-বাড়িতে মাসের খরচ বাড়বে, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়াবে, উৎপাদন ব্যায় বাড়াবে,জনসাধারণের খাদ্য, পরিবহন, সার, বিদ্যুৎসহ সব খরচ বেড়ে যাবে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ও আয় কমে যাওয়া মানুষ পড়বে আরো বিপাকে।
গ্যাস আমাদের সম্পদ। স্থল ভাগে ও সমুদ্রে থাকা গ্যাস যথাযথ ভাবে উত্তোলন করতে না পারা, যতটুকু সরবরাহ হচ্ছে, ততটুকুর দুর্নীতি ও অপচয় মুক্ত ব্যবহার করতে না পারার বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেই। বরং দেশীয় উৎসের ব্যবহারের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দেশকে ‘এলএনজি আমদানি নির্ভর’ করে ফেলা হচ্ছে। আমদানি খরচ বাড়ায় সাথে সাথে, বিশ্ব বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে,গ্যাসের এই দাম বাড়ানোকে যৌক্তিক দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এবার একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল,বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন। ২০১৪ সালে সমুদ্র বিজয়ের পর স্থল ভাগের সাথে সমুদ্রে গ্যাস তেল অনুসন্ধানের দাবিও সামনে চলে আসে। এ সময় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার তার সমুদ্র অংশে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ভান্ডার আবিষ্কার করেছে। আর আমরা স্থল ও সমুদ্র ভাগে গ্যাস অনুসন্ধান,উত্তোলনে কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করার পথ বেছে নিয়ে গ্যাসের আমদানি নির্ভরতা বাড়িয়ে দেই। প্রয়োজনের তুলনায় দেশের গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায়, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও এই পথকে মুনাফা অর্জনেরঅন্যতম পথ হিসেবে বেছে নেয়। সামগ্রিক ঘটনাবলীতে দেখা যায় সরকার সাধারণ জনগণের ও দেশের স্বার্থ না দেখে ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছে।সরকার এবিষয়ে নানা যুক্তি হাজির করতে পারে। তবে দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞরা বরাবর বলে আসছেন, ‘দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য জরুরি পদক্ষেপ না নিয়েই এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভর করার পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অপরিপক্ত,অদূরদর্শী এবং ভুল সিদ্ধান্ত। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধানের দুর্বল ধারণা বাংলাদেশকে এলএনজি’র ফাঁদে ফেলেছে।’
এদায় দেশের সাধারণ মানুষ নেবে না।ভোলার শাহবাজপুরের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সক্ষমতার থেকে অর্ধেক উৎপাদন করা হচ্ছে। ভোলা দ্বীপে অবস্থিত অপর ভোলা নর্থ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করা হয় নি। এ দুটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস পুরোপুরি তুলতে পারলে ও সরবারহ করতে পারলে ঐ অঞ্চলসহ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যেত। অথচ এখনো ভোলা দ্বীপ থেকে মূল ভূখন্ডের সংযোগ পাইপ লাইন স্থাপন করা হয় নি। অনেক এলাকায় গ্যাসের খবর নেই অথচ অহেতুক পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। আর যেখানে গ্যাস আছে সেখানে পাইপ লাইন হচ্ছে না। ছাতকের নাইকো দুর্ঘটনার পর আইনি জটিলতায় ঐ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলা যাচ্ছে না। ১৯ বছর ধরে আইনি জটিলতায় আটকে থাকা সমস্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর ছাতকের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে তোলা হয়েছে সামান্য গ্যাস।চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুর্বল কারিগরি ব্যবস্থাপনার কারণে এখনও গ্যাস উত্তোলন করা যায়নি। সিলেটের জকিগঞ্জে অবস্থিত গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবারহের ব্যবস্থা করা হয়নি।জরুরি ভিত্তিতে এসব ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন সরবরাহ না করার অর্থ ,গ্যাস সংকট টিকিয়ে রেখে দেশকে আরও এলএনজি আমদানি নির্ভর করে ফেলা। আর একের পর এক মূল্য বৃদ্ধি করে জনগণের উপর চাপ বাড়ানো।
তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৭৮ শতাংশ আসে দেশীয় উৎপাদন থেকে এবং ২২ শতাংশ আসে আমদানি করা এলএনজি থেকে। দেশীয় গ্যাসের পরিমাণ আরও কমে গেলে ও আমদানী করা এলএনজির পরিমাণ বেড়ে গেলে তার প্রভাব গ্যাসের দামের উপর পড়বে। তখন হয় সাধারণ মানুষকে বেশি দাম দিয়ে সামলাতে হবে, অথবা সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ(ভর্তুকির টাকাও তো জনগণের দেয়া টাকা) বাড়াতে হবে। যা অর্থনীতিতেও চাপ পড়বে। প্রশ্ন হলো, শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করে দেশের গ্যাস অনুস্থান ও উত্তোলনে জোর দেব না কেন? পাশের ত্রিপুরা, সেখানেও আমাদের থেকে বেশীকূপ খনন, অনুসন্ধান করা হয়েছে। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এর সক্ষমতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না।বাপেক্স এর সক্ষমতা থাকলেও ‘নানা স্বার্থে’ বিদেশি কোম্পানী কাজ দেওয়া হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে। এমনকি বাপেক্স এর পরিকল্পনায় থাকা বেশ কিছু কূপ খননের দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানীকে দেওয়া হয়েছে। এসবের ফলে বাপেক্সকে পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে। সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করা হচ্ছেনা। অপরদিকে বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে। যা দেশের মানুষকেই বহন করতে হচ্ছে। অথচ বাপেক্সকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। তাই স্থল ও সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেই গ্যাস সমস্যার সমাধান এর পথ খুঁজতে হবে। আর যেসব ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলা সম্ভব, সেক্ষেত্রে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব কাজ না করে বিশ্ব বাজারের দোহাই দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
এলএনজি আমদানিতে বিভিন্ন দেশের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি ও স্পট মার্কেটে মূল্য বৃদ্ধির পরও স্পট মার্কেট থেকে কিনতে বাধ্য হওয়া এবং বৈশ্বিক সংকটে, বিভিন্ন দেশের গ্যাস মজুদএর প্রবণতাও সংকট তৈরি করছে। এসব বিষয়েও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে।
দেশের গ্যাস উৎপাদন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ জ্বালানী ব্যবস্থাপনায় ননবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বাড়াতেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার সে পথে হাটবে না। তাইতো মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দাম বাড়ানোর প্রস্তাবকে আইনসঙ্গত করার প্রচেষ্টা চলছে। এবারো গণশুনানীর আয়োজন হবে ।
‘মুক্তবাজার’ এর নামে চলমান অর্থনীতিতে জ্বালানী খাতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত তো নিয়েই রাখা হয়েছে। তাই মানুষকে চোখেধুলো দিতে বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু করা হবে। যুক্তি তর্ক দেখান হবে। কোম্পানীগুলোর আবেদন থেকে একটু কম ধরে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সরকার, ব্যবসায়ী আর কমিশনভোগীদের মুখে খই ফুটবে, ‘মানুষের আয় বেড়েছে।’ ‘বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ালে আমাদের কী করার আছে।’ ‘গ্যাস কম মূল্যে দেওয়ার জিনিস নয়।’‘অমুক অমুক দেশে এই এই দামে গ্যাস বিক্রি হয়। আমাদের দেশে তো দাম কম।’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এরপর পর্যায়ক্রমে আসবে বিদ্যুৎ, পানির মূল্য বৃদ্ধি। আর গ্যাসের দাম বাড়লে সরাসরি এর প্রভাবে তো মূল্যবৃদ্ধি হবে। এটা টের পওয়া যাবে পথচলতে, বাজারে যেয়ে।
দেশের সাধারণ মানুষের কাধে সংকটের দায় মেটাতে মূল্যবৃদ্ধি চাপিয়ে দিয়ে জনদূর্ভোগ বাড়ানোর যে কোন গনবিরোধী প্রচেস্টা জনগনকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।
(সাপ্তাহিক একতায় )
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২।