সীমান্তবর্তী তুমব্রু, ঘুংধুম, রহমতেরবিল, ও হোয়াইক্যং এলাকা থমথমে, বিজিবি প্রধানের এলাকা পরিদর্শন।

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৪

 

[ এম আর আয়াজ রবি ]

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিরোধের জেরে, বিদ্রোহী গ্রুপ ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন বান্দরবন জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু,ঘুমধুম,
ঢেকুবনিয়া ও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালীর রহমতের বিল, আঞ্জুমানপাড়া থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে হ্নীলা পর্যন্ত এলাকায় অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে।
এখনো থেমে শুনা যাচ্ছে মর্টার শেল আর গুলির মুর্হুমুর্হু শব্দ। মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তে এপারে বসত ঘরে।

এখানে উল্লেখ্য যে,বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের ২৮৩ কি:মিটার সীমান্ত, যেখানে নাফ নদী ও সেন্টমার্টিন এলাকায় প্রায় ৫৪ কি: মিটার জলসীমা (প্রায় অরক্ষিত) সীমান্ত এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা হুমকির মুখে ফেলেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিরোধে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গার বাস, ঐপাড়ে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আরো ৩ লক্ষ প্রায়, ইতিমধ্যে প্রায় ৩ শতাধিক মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী( বিজিপি)’র সদস্য বিজিবি’র আশ্রয়ে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টারশেল ও গুলি, আকাশ পথ লঙ্ঘনের মতো ঘটনা হরহামেশা ঘটেই চলছে। মিয়ানমারের মর্টারশেলের আঘাতে ইতিমধ্যে নারীসহ ২ জন মারা গেছে। শুন্য রেখায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী বাহিনীর অভয়ারণ্য, আরসা, আরএসও ও নবী হোসেন বাহিনীসহ নাম না জানা বিচ্ছিন্নতা বাহিনীর অপতৎপরতা, ইয়াবা, মাদক, স্বর্ণচোরাচালানের মতো ঘটনা, অপহরণ, মুক্তিপণ, খুনোখুনি, রক্তপাত উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চলকে রীতিমতো বিষিয়ে তুলেছে।

সীমান্ত এলাকার বড় অংশ বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সীমান্ত–সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমার অংশে তাদের নিরাপত্তা চৌকি ও আরাকান রাজ্য দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চলমান ছিল।

তরই ফলশ্রুতিতে, শুন্য রেখা অতিক্রম করে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী (বিজিপি) ও জান্তা বাহিনীর সদস্যসহ অনেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করে অস্ত্র সমর্পণ করেছেন। এ পর্যন্ত ৩ শতাধিক বিজিপি এদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, অস্ত্র সমর্পণ করে নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে মানবিক কারণে আশ্রয় প্রদান করেছেন।

এদিকে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ( সোমবার) রাত থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি ( বুধবার) সকাল পর্যন্ত সীমান্তের ২টি বসত ঘরে মর্টার শেল এবং ৫টি ঘরে গুলি এসে আঘাত হেনেছে। মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে আহত হয়েছেন আরও পাঁচজন বাংলাদেশি।

গত সোমবার (৫-ফেব্রুয়ারি-২৪) দুপুর সোয়া ২ টার সময়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুংধুম ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের জলপাইতলীতে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে মিয়ানমারের নিক্ষিপ্ত মর্টারশেল বিষ্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ঘুংধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী এলাকায় জনৈক বাদশা মিয়ার স্ত্রী আসমা খাতুন (৫৫) ও তাদের পরিবারের ক্ষেতে কর্মরত জনৈক নবী হোসেন ( ৬৫) নামক ১ শ্রমিক নিহত হয়েছে।

সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্রোহী এলায়েন্সের উপর্যপুরী নিরাপত্তা চৌকি দখল, রাজ্য দখল অনেকের মনে হতে পারে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর পতন কেবলই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবতা এতো সহজ বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ আরও বিশেষ একটি কারণে। যদি কোনো কারণে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়, তখন আরাকান আর্মির প্রায় ৩০ হাজার প্রশিক্ষিত বাহিনী পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে এবং সাথে আরাকান রাজ্যে বর্তমান অবস্থানরত প্রায় ৪ লক্ষ রোহিঙ্গার ঢল আবারো বাংলাদেশ সীমান্তকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল করে দুঃচিন্তার কারণ ঘটাতে পারে।

উখিয়ার সীমান্ত এলাকার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর দেওয়া তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে গতকাল মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সারাদিন থেকে আজ বুধবার সকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পাঁচজন নাগরিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঘুমধুম সীমান্তে একজন, উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহতরা হলেন— পালংখালী ইউনিয়নের নলবনিয়া এলাকার আয়ুবুল ইসলাম, রহমতেরবিল এলাকার আনোয়ার হোসেন, পুটিবনিয়া এলাকার মোবারক হোসেন ও মো. কালু। তারা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

অন্যদিকে, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, আজকে টানা ৫-৬দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে আছে এলাকাবাসী। তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহাড় পাড়া থেকে আশ্রয় কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় ওপার থেকে গুলি এসে আহত হন মো. সৈয়দ আলম নামের একজন। তিনি তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহাড় পাড়া নিবাসী কাদের হোসেনের ছেলে। এছাড়া সীমান্তের ঘুমধুমের নজরুল ইসলামের বাড়ি, রহমতবিল সংলগ্ন অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নানের বাড়িসহ ৫টি বাড়িতে গুলির আঘাত লেগেছে।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শাহ মোজাহিদ উদ্দিন ও বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন। পরিদর্শন শেষে ডিসি শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, ঘুমধুম সীমান্তের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সীমান্ত এলাকার ২৪০ পরিবারের লোকজন ঝুঁকি রয়েছেন। এর মধ্যে স্থানীয় চেয়ারম্যান তাদের নিরাপদে সরে যেতে সহযোগিতা করছেন। ইতোমধ্যে সীমান্তবর্তী ১৫০ পরিবার নিজ উদ্যোগে নিকট স্বজনদের বাড়ি চলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। জলপাইতলী এলাকা থেকে ৩০ পরিবারেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। এর আগে বিজিবি মহাপরিচালক নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন করেন। মহাপরিচালক সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যদের খোঁজখবর নেন ও তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
পরে বিজিবি মহাপরিচালক মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘর্ষের জেরে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের খোঁজ নেন এবং আহত অবস্থায় আগত ও হাসপাতালে চিকিৎসারত বিজিপি সদস্যদের দেখতে যান।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, সীমান্তে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি তৎপর আছে। সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিজিবির নিয়ন্ত্রণে আছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ধৈর্য ধারণ করে, মানবিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে বিজিবি। পরিস্থিতি যা–ই হোক না কেন, অবৈধভাবে আর একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন ২৬৪ জন। তাঁদের আমরা বাসস্থান, খাবার ও নিরাপত্তা দিচ্ছি। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত আটজনের মধ্যে চারজন কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও চারজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’

বিজিবি প্রধান আরো বলেন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষায়, সীমান্ত এলাকায় শান্ত পরিবেশ বজার রাখার স্বার্থে বিজিবিসহ সবাইকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সীমান্তে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সদা তৎপর থাকতে হবে। একই সাথে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বরত সকল বিজিবি সদস্যের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন’।

পরবর্তীতে বিজিবি মহাপরিচালক মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘর্ষের জেরে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি), মায়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সকল সদস্যদের খোঁজ খবর নেন এবং আহত অবস্থায় আগত ও হাসপাতালে চিকিৎসারত বিজিপি সদস্যদের সরেজমিনে দেখতে যান।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘গত দুই দিনের তুলনায় আজকে (বুধবার) গোলাগুলির পরিমাণ একটু কম। এর আগে গোলাবারুদ, মর্টার শেল আমাদের দেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে। এ জন্য সরকারের সব পর্যায় কাজ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিজিবি সদস্যদের ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন এবং স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা হয়েছে। পত্রালাপ হচ্ছে। যারা আমাদের এখানে আশ্রয় নিয়েছে, মিয়ানমার তাদের নিয়ে যেতে প্রস্তুত। যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যেতে বলেছি। আমরা আশাবাদী, শিগগিরই এর একটি সমাধান হবে।’

তবে আরাকান আর্মি একটার পর একটা মিয়ানমারের মিলিটারি ও নিরাপত্তা চৌকি/ ঘাঁটি দখল করার খবর আমাদের জন্য যুগপৎ আনন্দের এবং উদ্বেগের। আনন্দের এই কারণে যে, আমরা আশা করছি (বিশেষ করে অনেক আশাবাদী নিরাপত্তা বিশ্লেষক) যদি আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যকে নিজেদের দখলে নিতে পারে, একইভাবে মিয়ানমারের অন্যান্য স্টেটে রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপগুলোর কাছে সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং এর প্রতিফলন হিসেবে মিয়ানমারে নতুন করে গণতন্ত্রায়ণ ঘটে, তাহলে মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গারা পূর্বের তুলনায় খানিকটা ভালো অবস্থায় যাবে।

তাছাড়া ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে বর্বর জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন কারার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কোনো কারণে যদি আরাকান আর্মি হেরে যায়, তাহলে রোহিঙ্গাদেরও এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তখন নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশে প্রবেশ করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।