উপকূল-সমতল-সমুদ্র ; হুমকিতে জীববৈচিত্র

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: মে ২২, ২০২১
– আ ন ম মোয়াজ্জেম হোসেন
পশুর চামড়া বা গাছের বাঁকলে নিজের লজ্জা নিবারন করে গুহায় বসবাস করা ও বনে জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো আজ এতটাই স্মার্ট হয়ে গেছে যে বন্যপ্রাণী বা বন্য পরিবেশ যেন তাদের শত্রু। অথচ পাথর টুকে আগুন জ্বেলে মাংস ঝলসে খেতে শেখার ইতিহাস এখনো শিশুরা পড়ছে পাঠ্য পুস্তকে।
তারা ভুলে গেছে জীববৈচিত্র সুরক্ষার দাবী উপেক্ষা করে বাস্তুতন্ত্র শুধু নয় বরং মানবসভ্যতা ঠিকিয়ে রাখা অসম্ভব , তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণ বৈচিত্র্য সুরক্ষার বিকল্প নেই। আজ মানুষের অপরিণামদর্শী আচরন পরিবেশ প্রকৃতি জলবায়ু ও জীববৈচিত্রকে জল – স্থলে এতটাই হুমকির সম্মুখীন করেছে এবং যা মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে এমন একটি পথে ধাবিত করছে যেখান থেকে ফিরে আসা হয়ত অসম্ভব !
মানুষ কখনো একা ছিলনা বরং জীব জগতের কোন কিছুই মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় ! অথচ আজ প্রকৃতির উদারতা দুহাত পেতে গ্রহনের বিনিময়ে তার সাথে শত্রুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরন করছে মানুষ । জেনে শুনেই তাকে প্রতিনিয়ত আহত করছি আমরা , তাকে নিজেদের প্রয়োজন মেঠাতে ও সৌন্দর্য অনুভবের জন্যই যেন অব্যাহত ভাবে ব্যবহার করছি।
আজ বনভূমি ও প্রাকৃতিক বন দখল করছে বিদেশী গাছ , যাদের বেশির ভাগ লাগানো হচ্ছে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যাদের কাজ শুধু নিজেকে দ্রুত বর্ধন করে আসবাব ও ব্যবহার্য কাঠ সরবরাহ করা, ফল ফুল দিয়ে বাস্তুতন্ত্র কে সমৃদ্ধ করতে নয়।
তেমনি পুকুর নদী নালা খাল বিলে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশী সব রাক্ষুসে মাছ, দ্রূত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক মৎস ভান্ডার।
কি উপকূল, কি সমতল, কি দ্বীপ, কি পাহাড়, কি সমুদ্র সর্বত্রই বিরাজ করছে মারাত্মক অস্তিরতা।
উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার একর সবুজ বেষ্টনী ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে তাতে হচ্ছে চিংড়ী ঘের ও লবন মাঠ।
সমতলে আরো ভয়াবহ অবস্থা, পরিবেশগত সমীক্ষা ব্যাতিত শত শত অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, নদী নালা খাল বিল, কৃষি জমি, পাহাড়, টিলা, সব বিরান ভূমি বানিয়ে তার বুকে চালানো হচ্ছে স্বপ্নের চাষ। ইট কাঠ পাথরের জঞ্জাল ডেকে ফেলেছে সমস্ত সবুজ প্রকৃতি, বৃষ্টির জলের ফোটার শেষ বিন্দুটিও নিশ্চিত নয় সে মাটি চুতে পারবে কিনা ! পাল্লা দিয়ে ধ্বংস হচ্ছে  ইকোসিস্টেম, ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ প্রতিবেশ, ধেয়ে আসছে ভয়াবহ এক সংকট, যার মাশুল গুনতে হবে আমাদের। বড়বে ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস সাইক্লোন টটর্নেডো বা এসিড বৃষ্টি, যার সবটাই মাথা পেতে নেওয়ার কোন বিকল্পের অবশিষ্টাংশ মানুষ বাঁচিয়ে রাখেনি  !
পাহাড়ের কথা কি বলব, বন্যপ্রাণী, পশুপাখি, গাছপালা, পাহাড়, মাটির উর্বরতা, প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য সবই আজ হুমকির মুখে। একদিকে তামাক, বনায়ন ও পর্যটনের নামে বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন, অন্যদিকে সনাতন পদ্ধতির জুম চাষের জন্যে পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে পাহাড়ের পশুপাখি – জীবজন্তু, প্রাকৃতিক বন ও বনের ইকোসিস্টেম সম্পূর্ণ ধ্বংস করেই তারা স্বপ্ন বুননের নামে শষ্য উৎপাদন করেন। এতে ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে হাজারো পশুপাখি জীবজন্তু ও গাছপালা। তেমনি তাদের রুচি ও খাদ্যাভাস এবং আমিষের চাহিদা মেঠাতে বনের পশুপাখি জীবজন্তু এমন কি কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজাতিও হারিয়ে গেছে চিরতরে।
আজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, মানুষের লোভে ধ্বংস হয়েছে তার ইকোসিস্টেম, ইতিমধ্যে লোভের ফাঁদে পড়েছে ছেঁড়া দ্বীপ। অন্যদিকে মহেশখালী দ্বীপ জুড়ে হচ্ছে পাওয়ার হাব –  যা কয়লা নির্ভর আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল পাওয়ার প্লান্ট। যেই মুহুর্তে সমগ্র বিশ্ব কয়লা নির্ভর বিদ্যুত প্রকল্প থেকে সরে আসছে, কার্বন থেকে ফিরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে হাটছেন, টিক তখনই দাতাদের প্রেসক্রিপশনে আমদানী নির্ভর কয়লা দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উটেপড়ে লেগেছি। যার লক্ষ লক্ষ টন ফ্লাইএ্যাশ আমাদের ফুসফুস কে ছারখার করে দিবে, ঠেলে দিবে মৃত্যুর মিছিলে। তেমনি সোনাদিয়া দ্বীপকে ঘিরে পর্যটন পরিকল্পনার নামে ইতিমধ্যে দ্বীপের বেশিরভাগ বড় গাছপালা কেটে উন্নয়ন শুরু হয়ে গেছে, অথচ এই দ্বীপের প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম ছিল আমাদের নয় বরং দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম সম্পদ ও সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র, যা রক্ষা করতে আমরা ব্যার্থ হয়েছি। তেমনি ভাবে জালিয়ারদ্বীপকে ঘিরে বেজার পর্যটন পরিকল্পনা, দক্ষিন এশিয়ার সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র নাফ নদীর মোহনায় গড়ে তোলা হচ্ছে এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোন, কুতুবদিয়ার ভাঙ্গন ঠেকাতে না পরলেও, বেড়িবাঁধ না হলেও এলএমজি টার্মিনাল সহ অসংখ্য পরিকল্পনা যেন থেমে নেই।
সমুদ্রের জীববৈচিত্র আজ হয়ত উপকূলের চেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন, গত দুই বছরে প্রায় ৩০ টি ডলফিন ও ৫ তিমির এবং শতাধিক সামুদ্রিক কাছিমের মৃত্যুর সাক্ষী আমরা। যাদের বেশির ভাগের মৃত্যুর কারন আজো অজানা, হয়নি পোষ্ট মর্টেম, হয়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ত্তত্ত্বাবধানে তাদের মাটি দেওয়া, বরং শেয়াল কুকুর ও কাকের আহার বনেছে অনেকে ! সামুদ্রিক জীববৈচিত্র সুরক্ষায় নেই কোন রেসকিউ টিম, নেই উদ্ধারের আধুনিক জলযান বা যন্ত্রপাতি, নেই কোন নীতিমালা, নেই সামুদ্রিক জীববৈচিত্র রক্ষায় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্টান, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্স বিভাগের আলাদা ফেকাল্টি করার তোড়জোড় করেও জমির অভাবে থেমে গেল !
অথচ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র উন্নয়নের নামে প্রকল্প বানিয়ে বুদ্ধিমানদের ক্লাবগুলোর দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বিদেশ ভ্রমন ও আনন্দভোজ থেমে নেই।
অথচ ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর হয়ে উটছে সমুদ্র রাষায়নিক বর্জ্য ও লক্ষ লক্ষ টন প্লাষ্টিক বর্জ্যের কারনে। সামুদ্রিক কাছিমের বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভয়ঙ্কর জেলি ফিশের প্রজনন, তাই সমুদ্র ও তার প্রতিবেশ ব্যবস্হা যে দ্রুত মানুষের হুমকি হয়ে উটছে তা নিশ্চিত।
উপকূল বা সমতল বা পার্বত্য অঞ্চলের জীববৈচিত্রের সুস্পষ্ট অবস্থান পত্র হয়নি কখনো, তাই সাধারন মানুষ জানেনা তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস, তাদের বৈশিষ্ট্য ও আচার আচরন, সবটাই মরিচিকা যেন ।  তাই জীববৈচিত্রের অবস্থানপত্র প্রনয়ন আজ সময়ের দাবী।
সারাদেশে আজ নির্বিচারে মরছে বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে বন বিড়াল, মেছোবাঘ, বাঘডাশা বা দাঁড়াশ বা অজগর।  দেশের কোন না কোন অঞ্চলে প্রতিদিন মরছেই মানুষের হাতে। যে প্রানীটি কৃষকের শত্রু ইদুঁর কে ধ্বংস করতে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে,  আজ মানুষ কে তার বন্ধু আর কে শত্রু না জেনে তাকে নির্বিচারে হত্যা করছে।
যেই পাখিটি ক্ষেতের পোকামাকড় কীটপতঙ্গ খেয়ে শষ্যকে নিরাপদ করতে এসেছিল তাকেই কৃষক ফাঁদ পেতে শিকার করছে, সুস্বাদু আহারের বস্তুতে পরিনত করছে।
বন সংকোচন ও ধ্বংসের বনের খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ার ফলে যে প্রানীটি লোকালয়ে এসে ফলমূল খেয়ে বনের গভীরে গিয়ে পয় প্রণালীর মাধ্যমে বনের মাঝে সেই ফলের চারা গজানোর মাধ্যমে বনের ইকোসিস্টেম ফিরিয়ে আনত, তাকেই পিটিয়ে মেরে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করছে মানুষ।
শখরে বশে বিদেশ থেকে আনা রাক্ষুসে মাছটাকে একুরিয়ামে ধারন করা অসম্ভব হলে পাশের পুকুরে ছেড়ে দিচ্ছেন আর সে পুকুরের সব সাবাড় করে, তার বংশবিস্তার করার মাধ্যমে নদী নালা খাল বিলে ছড়িয়ে পড়েছে, আর দেশীয় সব মাছের গুষ্টি সহ খেয়ে সে এখন চলে এসেছে আমাদের প্লেটের সুস্বাদু মাছ হয়ে !
যে হাতি এই সভ্যতা বিনির্মানের জন্য সবচেয়ে ভারী বোঝাটি বহন করে মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে নিজের রক্ত ঘামে তাকেই আজ নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে মানবসভ্যতার হুমকি বিবেচনা করে। ইতিমধ্যে তার শত বছরের করিডর গুলো সুরক্ষিত রাখার বদলে গড়ে তুলেছে অপরিকল্পিত বাসস্থান, হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্টান ও উন্নয়ন পরিকল্পনা তাই এই শতাব্দী হয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার বিলুপ্তি অনিবার্য।
এভাবেই নির্বিচারে শুধু বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র মরছে তা নয়, বরং আক্রান্ত হচ্ছে ইকোসিস্টেম, পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে, ভেঙ্গে পড়ছে বিভিন্ন প্রানীর খাদ্য শৃঙ্খল, সৃষ্টি হচ্ছে অস্তিরতা, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন রোগ, তা ছড়িয়ে পড়ছে মানব দেহেও, আর তাই পৃথিবী আজ আহত। আজ আমরা সেই স্থানে পৌছে গেছি নিজেদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারনে যেখান থেকে ফিরে আসা হয়ত অসম্ভব। তাই জীববৈচিত্র রক্ষা না হলে মানবসভ্যতা ঠিকিয়ে রাখা অসম্ভব। তাই আসুন জীববৈচিত্র রক্ষা করি আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে।
লেখকঃ আ ন ম মোয়াজ্জেম হোসেন 
প্রেসিডেন্ট, সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশ