মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন বিরোধে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমারের ৬৬ বিজিপি সদস্য-ভয়, আতংকে স্থানীয়রা

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪

 

।। এম আর আয়াজ রবি, সীমান্ত এলাকা উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে।।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন বিরোধে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমারের ৬৬ বিজিপি সদস্য, আতঙ্কে পালাচ্ছেন স্থানীয়রা- সীমান্তবর্তী ৬ টিশিক্ষাপ্রতিষ্টান অঘোষিত বন্ধ ঘোষণা।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে প্রধানতঃ তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং আরাকান আর্মি’র—সমন্বয়ে গঠিত ‘ব্রাদারহুড অ্যালাইয়েন্স’র সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি)’র। প্রচন্ড আক্রমনের মুখে একপ্রকার প্রাণে বাঁচার আকুলতা নিয়ে বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্ত অতিক্রম করে বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন মিয়ানমার বিজিপি’র ৬৬জনের একটি সশস্ত্র দল।

রোববার ( ৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টার দিকে তারা (মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য) বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে প্রবেশ করে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ( বিজিবি)’র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন ও পরে আত্মসমর্পণ করেন। এরপরই তাদেরকে বিজিবির তুমব্রু ক্যাম্পে নিরাপদ হেফাজতে নেয় বিজিবি।

বিজিবির ৩৪, টেকনাফ ব্যাটালিয়ন প্রধান লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি বিজিবির সেক্টর ও বিজিবি সদর দপ্তরের জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তুমব্রু এলাকার অধিবাসীরা শনিবার রাত থেকেই মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এরই মধ্যে সকালে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে ছোঁড়া গুলিতে তুমব্রু এলাকায় একজন বাংলাদেশী গুলিবিদ্ধ হন।
এদিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে প্রবীর ধর নামে এক বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। আজ সকালে নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে শনিবার থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত মিয়ানমারের ছোঁড়া দুটি মর্টার শেল ও একাধিক গুলি এসে পড়েছে তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে গ্রাম ছেড়েছে অনেকে। যদিও সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘর্ষ ও উত্তেজনায় বিজিবির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানানো হয়।
ধুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আলম বলেন, শনিবার সন্ধ্যা থেকে যে পরিমাণ গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে আগে তেমনটা শোনা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। শনিবার দিবাগত রাত ও রোববার সকালে তুমব্রুর কোনারপাড়ার ইলিয়াস হোসেনের বসতঘরের টিনে পড়েছে মর্টার শেল। তবে কেউ হতাহত হয়নি।
তথ্যমতে, দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে থেমে থেমে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে ব্যবহৃত গোলা ও মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের লোকালয়ে এসে পড়ছে। এর আগেও মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়েছে এই এলাকায়। এ ছাড়া টেকনাফের উলুবনিয়ায় মর্টার শেল এবং উখিয়ার পালংখালীর বটতলী এলাকায় গোলার ভাঙ্গা অংশ এসে পড়ে।
এর আগেও মর্টার শেল ও গোলার অন্তত চারটি অংশ নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু, কোনারপাড়া ও পশ্চিম ঘুমধুমে এসে পড়ে। বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন করেন।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মিয়ানমারে এখনো প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি আমরা। এবার গোলাগুলির শব্দের তীব্রতা বেশি হওয়ায় সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের মানুষকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে উখিয়া এবং টেকনাফ সীমান্তে রাতে থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা গেলেও সকাল নয়টার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনতে পায় স্থানীয়রা।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমাদের সীমান্তে থেমে-থেমে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে বরাবরের মতো রোহিঙ্গা এবং বিদ্রোহীরা যেন আমার দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে তিনি জানান।
এদিকে, বরাবরের মতোই সীমান্তে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে আছে বিজিবি। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাকেও আর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।

টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার এইচ এম লুৎফুল লাহিল মাজিদ বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সীমান্তে অনেকটা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের নতুন করে অনুপ্রবেশের খবরও রয়েছে আমাদের কাছে। তবে এসব কিছুতে বাংলাদেশ যেন ভুক্তভোগী না হয় সেদিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে সবদিক থেকে। নিরাপত্তায় আমরা কোনো ছাড় দিতে রাজি নই।
ক্যাম্পে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, মিয়ানমারের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের যাতে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয় সেই বিষয়টি আমরা খেয়াল রাখছি। পাশাপাশি প্রতিটি চেকপোস্টে আমাদের কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে প্রবেশ করানো হবে না।
শরণার্থী কমিশন বলছে, নতুন করে যেকোনো অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসান কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। তবে আমাদের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির মতো রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের অ্যালায়েন্স সংগঠন আরসাও সংঘাতে জড়িয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার সেনা চৌকিতে অতর্কিত হামলার পর মাত্র একদিনেই পরাজয় স্বীকার করে নেয় আরসা। আর তার ফলাফল হিসাবে ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে, প্রচন্ড গোলাগুলি ও মর্টারশেলের আঘাতের কারণে তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার ৬ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ছেন সীমান্তের অনেক বাসিন্দারা। মিয়ানমারে সংঘর্ষের সময় সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ও মর্টারশেল বাংলাদেশে আসায় জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, কোনারপাড়া, ভাজাবনিয়া ও বাইশফাঁড়ি এলাকার শত শত পরিবার। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তের ১০০ গজ দূরত্বে থাকা মিশকাতুন নবী দাখিল মাদরাসাসহ সীমান্ত এলাকার ৬টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুল মান্নান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আজ (রোববার) সকাল থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার অভ্যন্তরে গোলাগুলি বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্ত এলাকার বাইশ ফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কুল তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ গুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে গ্রাম ছেড়েছে অনেকে। যদিও সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘর্ষ ও উত্তেজনায় বিজিবির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানানো হয়।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্রোহী এলায়েন্সের উপর্যপুরী নিরাপত্তা চৌকি দখল, রাজ্য দখল অনেকের মনে হতে পারে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর পতন কেবলই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবতা এতো সহজ বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ আরও বিশেষ একটি কারণে। যদি কোনো কারণে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়, তখন আরাকান আর্মির প্রায় ৩০ হাজার প্রশিক্ষিত বাহিনী পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে এবং সাথে আরাকান রাজ্যে বর্তমান অবস্থানরত প্রায় ৪ লক্ষ রোহিঙ্গার ঢল আবারো বাংলাদেশ সীমান্তকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল করে দুঃচিন্তার কারণ ঘটাতে পারে।