দক্ষিণের জনপদ উখিয়া উপজেলার উন্নয়ন ধারণা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা।

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২০

(১ম পর্ব)
এম আর আয়াজ রবি :

বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের সীমান্তবর্তী জেলার একটি ছোট উপজেলার নাম উখিয়া উপজেলা। উখিয়া উপজেলা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের আলোচিত একটি উপজেলা। মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত ১৪ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাদের বসবাস এ উপজেলার বিভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত হওয়া্র সুবাদে এ উপজেলা বিশ্ব দরবারে বেশ আলোচিত ও পরিচিত।

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশের লীলালিকেতন অনিন্দ্য সুন্দর এক জনপদের নাম উখিয়া। এটি কক্সবাজার জেলার দক্ষিণাংশে ২১°০৮´ থেকে ২১°২১´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৩´ থেকে ৯২°১২´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে উখিয়া উপজেলার অবস্থান। এ উপজেলার আয়তন প্রায় ২৬১.৮০ বর্গ মিটার.। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে এ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। এ উপজেলার উত্তরে রামু উপজেলা,পূর্বে বান্দরবান জেলার মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ, দক্ষিণে টেকনাফ উপজেলা এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।

একটি জনপদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পেছনে, অত্র এলাকার গনমানুষের ইতিবাচক ভুমিকা, সাথে উক্ত এলাকার নেতৃস্থানীয় নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দলসমুহের সদিচ্ছা, গঠনমুলক ভুমিকা, সরকারি, বেসরকারি অনুদান, সহযোগিতা, সরকারি বরাদ্দের সুষ্ট বিলিবন্টন, যথাযথ বাস্তবায়ন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভুমিকা, তড়িতকর্মা মনমানসিকতা, সত্যিকার অর্থে জনপ্রতিনিধিদের এলাকার উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডে সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন, বাস্তবায়নের সদিচ্ছা, জনবান্ধব হিসেবে এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করা প্রভৃতি ইতিবাচক ও গঠনমুলক ভুমিকার উপর অনেকখানি নির্ভর করে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম ও প্রাচিনতম দল আওয়ামীলীগ। যে দলটি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে অন্যতম ভুমিকা গ্রহনকারী দল বা স্বাধীনতার স্বাদ লাভের নের্তৃত্বপ্রদানকারী দল। যে দল শের এ বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওর্দীসহ জাতির প্রয়োজনে গর্জে উঠা জাতীয় চার নেতাসহ অগণিত বীরসমুহের সাথে বাংলার স্বাধীনতা তৃপ্তির মুল নায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাংগালী বলে খ্যাত বংগ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দক্ষ নের্তৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জ্বত ও আব্রুর বধৌলতে আজকে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। এ স্বাধীনতা বাংলার দামাল মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক দামাল ছেলেরা ও মুক্তযোদ্ধাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা দেশের মানুষের উন্নত জীবন যাপন ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নে লালিত সোনার বাংলা গড়ার মুল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সমস্ত বাংগালী পশ্চিমা হায়েনা ও শকুনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে জয়ী হয়ে গড়ে উঠা স্বাধীন দেশের উড্ডীয়মান লাল সবুজের গৌরবের পতাকা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নের্তৃত্বপ্রদানকারী প্রাচিনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ রাষ্ট্র শাসন ক্ষমতার পরপর তৃতীয় মেয়াদ চলমান রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র উপহার দেবার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২০০০ সালে শুরু হওয়া ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ (এমডিজি) বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের সময় শেষ হয় ২০১৫ সালে। এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ খুব ভালভাবে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বৈতরনী পার করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ভাষাতেই এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে অনুসরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে ৷ বাংলাদেশকে বলা হয় এমডিজির ‘রোল মডেল’৷
এরপর জাতিসংঘ ঘোষণা করে ১৫ বছর মেয়াদি ‘Sustainable Development Goals (SDGs) বাটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) হলো ভবিষ্যত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ লক্ষ্যমাত্রা। জাতিসংঘ লক্ষ্যগুলো প্রণয়ন করেছে এবং “টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা” হিসেবে লক্ষ্যগুলোকে প্রচার করেছে। এসব লক্ষ্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-কে প্রতিস্থাপন করেছে, যা ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। SDGs-এর মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল। এতে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘ প্রদত্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রানপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিওবা সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনভাবেই এত সহজ হবেনা, তথাপি বৈশ্বিক অতিমারী করোনা কালে যেখানে সারা পৃথিবী আজ ঝিমিয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং হাজার হাজার, লক্ষলক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে মৃত্যু বরণ করেছেন। করোনা ভাইরাসের টিকা আবিস্কারের সংগ্রামে সারা বিশ্ব এখন ততস্থ। আসলেই এখনও কোন দেশ সফলভাবে করোনা ভ্যাক্সিন আবিস্কার করতে সক্ষম হননি তবে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। তাই করোনা টিকা আবিস্কার ও সাধারন মানুষের মধ্যে অতি সহজে পুরোমাত্রায় ভ্যাক্সিনেশন করার পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে সেটা সময় ঠিকই বলে দেবে। তারপরও আমরা আশাবাদি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সারা বিশ্ব অন্যান্য মহামারী/অতিমারীর বিরুদ্ধে টিকে আবিস্কার করে যেরুপ জয়ী হয়েছেন ঠিক তেমনি করোনার বিরুদ্ধেও জয়ী হবে এ আশাবাদ আমরা ব্যক্ত করতেই পারি।

বলছিলাম কি, উখিয়া উপজেলার উন্নয়ন বিষয়ে ভাবনাগুলো! ধারাবাহিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে সুবিধা হচ্ছে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড একটি নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি ও প্যারামিটার দিয়ে চলমান থাকে যা অতি সহজে তা মাপা যায় ও গতিবিধি সঠিকভাবে ফোরকাস্ট করা যায় বা পর্যবেক্ষন করা যায়। গত দশকে বাংলাদেশের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ইতিবাচক ভুমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে চোখে পড়ার মত। কিছু কিছু সেক্টরে বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে অনেক অনেক উপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ছোঁয়া বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা উখিয়া জনপদেও সঠিকভাবে লেগেছে। গত দশক হচ্ছে উখিয়ার উন্নয়ন ও অগ্রগতির দশক বলে পরিগনিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের ২৫শে আগষ্ট থেকে মায়ানমার বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্টির বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্র ধরে উখিয়ার পরিবেশ, প্রতিবেশ, পাহাড়, পর্বত, বনভুমি উজাড় করে তাদেরকে আবাসন স্থাপনার সুযোগ করে দেওয়ায় প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে রীতিমত হুমকি করে তুলেছে।রোহিঙ্গা জনগোষ্টির আগমনে এতদঅঞ্চলে কত হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবেনা। অধিকন্তু বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য রীতিমত গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দাড়িয়েছে।রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হবার সুবাদে এখানকার জীবনযাত্রার ব্যয় মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা ও যোগানের নেতিবাচক প্রভাবে একানকার স্থানীয়রা সংখ্যালঘু হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। দেশি বিদেশি এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য মৌলিক অধিকারসমুহ পূরণ করার চেষ্টা করলেও হোস্ট কমিউনিটির জন্য সেসকল এনজিওগুলো তেমন কিছু করছেনা। অধিকন্তু বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এনজিওদের মোট অনুদান বা খরচের ৩০% হোস্ট কমিউনিটির জন্য ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিভিন্ন ছুতোয় তা ঊপেক্ষা করেছে। হোস্ট কমিউনিটির বাসিন্দাগুলো রীতিমত অতীব দুঃখের সাথে কালাতিপাত করছেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় জন প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি সমাজ ও সাধারন আম জনতা হোস্ট কমিউনিটির অধিকার আদায় ও তা জনস্বার্থে সমবন্টনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা সাধন ও জবাবদিহীতার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে বলে সাধারন সচেতন মহল মনে করেন। এখানে রক্ষকরা ভক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে অনেকেই সরব আছেন কিন্তু জনপ্রতিনিধি ও নেতা নেতৃরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ‘ডিল’ করতে গিয়ে অনেক কিছু লেজে গোবরে করে, এক জটিল অবস্থার সৃষ্ঠি করেছে বলে আপাতঃ দৃষ্টে মনে হচ্ছে। গত তিনবছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যত হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন মুলক কাজ ও অনুদান প্রদান করা হয়েছে, সত্যিকার অর্থে তার ৩০% যদি হোস্ট কমিউনিটির জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হতো, হোস্ট কমিউনিটিরা আজ দুবাই সিঙ্গাপুরের মত এলাকায় রুপান্তর হতে বাধ্য হতো! স্থানীয়দের সাথে বিভিন্ন এনজিও/আইএনজিও সংস্থা যেমন বিমাতাসুলভ আচরন করেছেন, ঠিক রাষ্ট্রযন্ত্রও স্থানীয়দের উপর চালিয়েছেন ষ্টীম রোলার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকুরীর ক্ষেত্রে বা নিয়োগের ক্ষেত্রে ৭০% স্থানীয় শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য বরাদ্দ দেবার কথা থাকলেও স্থানীয় শিক্ষিত জনগোষ্টির চাকুরীর বাজার অত্যন্ত সীমিত। যারাই অল্প স্বল্প বিভিন্ন মাধ্যমে চাকুরী পেয়েছেন তাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে চাকুরীচ্যুত করার জন্য মিডলেভেল ম্যানেজম্যান্ট এক পায়ে খাঁড়া। কারন এনজিওদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতির যে রমরমা অবস্থা তা স্থানীয়রা ঠের পাবেন এবং কোনভাবে স্থানীয়রা সংঘবদ্ধ হয়ে সেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন ভয়ে স্থানীয়দেরকে চাকুরীর ক্ষেত্রে বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে হয় হর হামেশা ! তাছাড়া স্থানীয়রা মারাত্মম স্বার্থপর। স্থানীয়দেরকে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করার সুযোগ করে দিলে স্বাবলম্বী হবে, সামাজিকভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, সমাজের আশরাফ আতরাফ ভেদাভেদ ভেদ করে একটু উন্নত মনমানসিকতায় পর্যবসিত হতে পারেনা। ধন্যবাদ সবাইকে। (চলবে……)
লেখকঃ কলামিষ্ট ও সম্পাদক ‘আইকন নিউজ টুডে’ ।

( সীমান্তবাংলা/ ৯ ডিসেম্বর ২০২০)