উখিয়ায় কোটিপতি তকমাদারীর আয়ের উৎস ও সামাজিক অবস্থান এবং মাদক প্রতিরোধে প্রশাসনিক দুর্বলতার ছাপ!

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২২

 

এম আর আয়াজ রবি

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে চলেছে। সম্পদ আহরণ ও অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে অসমতা মানবসভ্যতার এক চিরায়ত সমস্যা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে মানুষে মানুষে আয় বৈষম্য ও অসমতাও বেড়ে গেছে বহুদুর। সেই বৈষম্য ও অসমতা যদি হয় বৈধতা ও অবৈধতার প্রশ্নে-তাহলে নিশ্চয়ই অবৈধতার বৈষম্য ও অসমতাকে লাগাম ঠেনে ধরতে হবে শক্ত হাতে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না!

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায়, উখিয়া- টেকনাফ বর্তমানে ইয়াবা কারবারীর নিরাপদ জোন ও ট্রান্সজিট পয়েন্ট এবং রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে দেশে ও সারাবিশ্বে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। একসময় হেরোইন ড্রাগ ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘গোল্ডেন ট্রাই এঙ্গেল’ নামে যে তিনটি দেশের নাম পরিচিত ছিল তা হচ্ছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস, এখনও সেই দেশগুলো মাদক উৎপাদন, বিপণন ও রোটম্যাপ হিসেবে খুবই পরিচিতি লাভ কয়েছে।বর্তমানে বাংলাদেশকেও আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র নিরাপদ ইয়াবা চোরাচালানের রুট ম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করছে।

ইয়াবা সবচেয়ে বেশী উৎপন্ন হয় মিয়ানমারে। ইয়াবার নিরাপদ স্থান, নিরাপদ রোড, ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে উপযুক্ত বিবেচনা করেই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় নাফ নদীর কাছে ৩৭টি ইয়াবার কারখানা তৈরী করেছে মিয়ানমার। দীর্ঘ সময় সামরিক জান্তা ক্ষমতায় থাকার কারণে সেখানে ইয়াবার ব্যবসা জমজমাট। আর সীমান্তবর্তী হওয়াতে এই ইয়াবা খুব সহজে চলে আসে বাংলাদেশে। মায়ানমার রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় এখন রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গারা ইয়াবা ও চোরাচালানের বদৌলতে কাড়ি কাড়ি টাকা অর্জন করে হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার খবর ও সেই অস্ত্র আশ্রয়দাতা বাংলাদেশীর উপর প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন সাধের কথাও বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে আসছে। এই সংবাদ সত্যিই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার প্রশ্নে নিশ্চয়ই এক মারাত্মক নেতিবাচক অধ্যায়।

আমাদের দেশে ইয়াবার একটা চড়া বাজার থাকায়- ইয়াবা পাচারের বিভিন্ন রোড ম্যাপ এবং ট্রান্সজেকশন পয়েন্টও পাওয়া যায়। সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনী ইয়াবার চালান আটক করার খবরাখবর পাওয়া যায়। কালে ভদ্রে ইয়াবা চোরাকারবারের সাথে আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে যা ধরা পড়ছে তা নিতান্ত স্বল্প এবং যারা ধরা পড়ছেন তারাও নিতান্ত নস্যি, চুনি পুটি মাত্র ! রাজনৈতিক পরিচয়ে ও বিভিন্ন কুটকৌশলের ছদ্মাবরনে ইয়াবার মুল কুশীলব বা গড ফাদাররা থাকেন ধরা ছোঁয়ার একবারে বাইরে! পরিসংখ্যানে প্রকাশ, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকার কারণে দেশে চোরাচালানে আসা মাদক দ্রব্যের ১০ শতাংশ মাত্র উদ্ধার করা হয়। ৯০ শতাংশ ইয়াবা থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইর, প্রশাসনের অগোচরে !

সারাদেশেই ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এই মরণ নেশার ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের তালিকাও জেলাভিত্তিক প্রস্তুত করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ইয়াবার ব্যবসার সঙ্গে কতিপয় মাঠপর্যায়ের পুলিশ,এপিবিএন, বিজিবি কর্মকর্তা ও সদস্য ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সোর্সরা জড়িত রয়েছে বলে সুত্রে প্রকাশ। শুধু তাই নয়, অনেক এলাকায় কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা ও সোর্সরা ইয়াবার ডিলারশীপ নেবার কথাও শুনা যায়। সম্প্রতি পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে অভিযোগ করেছেন, মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে পুলিশের মাঠপর্যায়ের কতিপয় সদস্য ও কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন। এরপর মাদক বাণিজ্যের মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষকদের গডফাদারদেরও তালিকা করা হচ্ছে। আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তাদের নামও ওই তালিকায় রয়েছে বলে জানান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন উপ-পরিচালক জানান, এদের তালিকা আমাদের কাছে নেই। তবে পুলিশের সোর্স আর কোন কোন ব্যক্তি ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা করেন, তা আমাদের জানা আছে। আর সোর্সরা তো অলয়েজ ক্রিমিনাল। তাদের হ্যান্ডলিংয়ের পদ্ধতি মোতাবেক ব্যবহার করতে হয়। এখন কে কীভাবে তাদের ব্যবহার করছে সেটা দেখার বিষয় বলে জানান তিনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সদের তালিকা করা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ী, তাদের গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদের নাম, পিতার নাম, তাদের রাজনৈতিক দলীয় ও প্রশাসনিক পরিচয় ওই তালিকায় রাখা হচ্ছে। সারাদেশের ৬৪ জেলায় পুলিশের ইউনিটপ্রধানরা এই তালিকা তৈরি করে নিজ ইউনিটের কাছে সংরক্ষণ ও পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সারাদেশের মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক গডফাদারদের তালিকা বিচ্ছিন্নভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাছে রয়েছে। ওই তালিকার ভিত্তিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতি সপ্তাহে দুবার অভিযান চালাচ্ছে। জানা গেছে, সারাদেশের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে রয়েছে। এসব মাদক ব্যবসায়ী বা ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই মাদক আন্ডারওয়ার্ল্ডে তারা ডন হিসেবে পরিচিত। আবার তারা গডফাদার হিসাবেও পরিচিত। তাদের হাতেই দেশের মাদক বা ইয়াবা বাণিজ্যের সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ। অনেকে সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতা। ওয়ার্ড, থানা বা মহানগর নেতা থেকে খোদ সংসদ সদস্য থেকে সিআইপি খেতাব পাওয়া ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে সরকারী কর্মকর্তারাও মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা হাতেনাতে মাদক উদ্ধার করা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারার সীমাবদ্ধতায় মাদক ব্যবসায়ী বা ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।

তাছাড়া, বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা উখিয়া টেকনাফের অনেক বড় বড় নেতা, রথি-মহারথি, জনপ্রতিনিধি, জনসেবক, সমাজ সেবক, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাকটরসহ সমাজের তথাকথিত মুখোশ পরা ভদ্র লোক, যাদের বৈধ, অবৈধ কাঁচা পয়সার গরমে আমজনতা মারাত্মক নাজেহাল অবস্থায়, কষ্টে ও অস্বস্তিতে থাকেন। এই মুখোশ পরা ভদ্রলোকগুলো কর্তৃক সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, গুম,খুন, রাহাজানি, অবৈধ জমি দখল,ধর্ষণ, লুটতরাজসহ হেন অপরাধ নেই সমাজে তারা করেনা বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা জড়িত থাকেনা।

সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা রাতারাতি আংগুল ফুলে কলাগাছ থেকে বটগাছ হয়ে গেছে, কিন্তু তারা এই অল্প ক’দিন পুর্বেও দিনে এনে দিনে খেতে পারতনা! এমন অনেক তথাকথিত কোটিপতি চোখে পড়ে, যারা রিক্সা চালাত, বিভিন্ন বাড়িতে রাখাল বা দিনমজুরের কাজ করত! বন থেকে গাছ/কাঠ কেটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। পড়ালেখার বালাই নেই, অনেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজের ধারে কাছে যাবার ও সুযোগ হয়নি! আবার অনেকেই আছে প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেনি! আর কিছু আছে আন্ডার মেট্রিক! একসময় তারা খুব কষ্ট করে কালাতিপাত করতে সাধারন মানুষের চোখের দেখা। আজ তারা কিভাবে, এত অল্প সময়ে, কোন আলাউদ্দিনের চেরাগের হদিস পেয়েছে যে, রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেল?সমাজ সচেতন প্রত্যেকেই জানেন সেই চেরাগ বা সোনার চামচ আসলেই কি যার বদৌলতে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন!

‘র‍্যাশনাল পিপলস’ এর মনে প্রশ্ন জাগে, সরকারী যথাযথ কোন কর্তৃপক্ষ কোন দিন সেসব অবৈধ কারবারের সাথে যারা জড়িত আছেন, তাদের জিজ্ঞেস করেছেন-আসলেই তারা কি করেন? কি তাদের ব্যবসা? কি তাদের টাকার বানানোর আয়ের উৎস বা কিবা তাদের সোর্স অব ইনকাম? তারা সরকারকে কত টাকা আইকর, ট্যাক্স বা ভ্যাট প্রদান করেন ? কি অবস্থা তাদের ব্যক্তি রিটার্ণ দাখিলার ? কি তাদের ব্যক্তি প্রোফাইল ও আইডেন্টিটি? কিভাবে তারা রাতারাতি এত টাকার মালিক হল? কারা তাদের গড ফাদার? কাদের হাত ধরে তারা এত এত অপরাধ করে যাচ্ছে? কারা তাদেরকে শেল্টার দিচ্ছে? কারা তাদেরকে পৃষ্টপোষকতা দিচ্ছে? কারা কারা সেই বিভিন্ন অবৈধ কাজের বেনিফিসিয়ারী? এসব প্রশ্নের ‘লা জবাব’ অবস্থা আমাদের আইন শৃংখলা বাহিনী ও অন্যান্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। (চলবে….)

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।