“টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা ‘এস ডি জি ‘ঘোষনার পূর্বেই বাংলাদেশের লৌহ মানবী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়ন রুপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ ঘোষনা করেন যেখানে টেকসই উন্নয়নের উপরই জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সম্পদের স্বল্পতা ও সমবন্টনের সমস্যা প্রকট। বৃটিশ ও পাকিস্থানী শাসকরা এ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে রেখে গিয়েছিলো। সেখান থেকে ৪৯ বছরে একটা দেশ সক্ষমতা অর্জন কখোনই করতে পারবেনা। কিন্তু বাঙ্গালিদের অসীম ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম ও সরকারের দুরদর্শী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আমাদেরকে অবিশ্বাস্যভাবে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”র অনেক সূচক অর্জনে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”র অনেক সূচকে ভারত ও পাকিস্থান থেকে এগিয়ে আছে..।”
বেশ কিছু কারণেই ২০২০ সালের বিজয় দিবস অন্যরকম তাৎপর্য বহন করে। প্রথমত, আমরা দেশ হিসেবে স্বাধীনতার অর্ধশত তম বছরে পদার্পণ করেছি এই বিজয় দিবসের মধ্য় দিয়ে। বাঙ্গালী জাতি ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যার নেতৃত্বে দেশের আপমর জনগন দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশেকে স্বাধীন করেছে, সেই রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষকী উপলক্ষে দেশে মুজিব শতবর্ষ ঘোষনা করে বিশেষ কিছু উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। সেক্ষেত্রে এবারের বিজয় দিবসের তাৎপর্য অনেক। আরো অনেক গুলো বিষয়ে মধ্যে দুটি বিষয় না বললেই নয়: প্রথমত সমগ্র পৃথিবী এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। নাগরিক জীবন থেকে শুরু করে মৌলিক চাহিদা ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড, শিক্ষা এবং কর্মজীবনে সমগ্র পৃথিবী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ যেন পৃথিবীর নতুন রুপ! যেন নতুন একটি যুগে প্রবেশ করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে করোনা মহামারী!
আরেকটি স্বপ্ন পূরণে মোহের মধ্যে আছি আমরা এখনো! দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মান করা হয়েছে! যা অবিশ্বাস্য এক পরিকল্পনার দৃশ্যমান সমাপ্তি ঘঠতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কাঠামো নির্মান হয়েছে। এই সেতু কেবল দক্ষিন–পশ্চিমাঞ্চল নয় , পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থায় পরিবর্তন আনবে। অনুমান করা হচ্ছে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পযর্ন্ত বেড়ে যাবে ব্রীজের যতাযত ব্যাবহার নিশ্চিত হলে। শুধু অভ্যন্তরিন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নয়, বরং এটি দক্ষিন এশিয়া ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার যোগাযেোগ ব্যবস্থা, বানিজ্য, পর্যটন সহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই এটি আমাদের স্বপ্নের সেতু।
এই বিষয়গুলো আমার দৃষ্টিতে ২০২০ সালের বিজয় উদযাপন অধিক সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।
আমাদের উন্নয়ন ভাবনাঃ
তো একটা প্রশ্ন থেকেই যায়! আমরা ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল, এই ৪৯ বছরের যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবুন্ধুর নেতৃত্বে সাধারণ জনগন দেশেকে স্বাধীন করেছিলো, সে লক্ষের দিকে কতোটা এগোচ্ছি আমরা? কিংবা কতোটা পিছিয়ে আছি? উন্নয়ন বলতে আসলে আমরা কি বুঝাচ্ছি ? আমরা ৪৯ বছরের নবীন একটি দেশের উন্নয়নে সফলতা বা ব্যর্থতা বিচার করতে হলে এই বিষয় গুলো বুঝতে হবে। বলার জন্য বা প্রয়োজনের স্বর্থে আমরা অনেক কিছু বলতে পারি। এবং এটাই স্বাভাবিক, কারণ সবাই উন্নয়নের সামগ্রিক বিষযগুলো বুঝাতে পারে না বা পারবে না। দেশের নীতি-নীর্ধারক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন কাজের যারা জড়িত আছেন তারা ধারনা রাখেন বিভিন্ন মাত্রায়।
মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মতো বিষয়গুলো অতিপ্রয়োজনীয় হলেও একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির সাথে আরো অনেক গুলো বিষয় জড়িত। আমরা হয়তো মনে করি মৌলিক চাহিদা বা শুধু অবকাঠমো নির্মানগত কর্মকান্ড গুলোই উন্নয়নের প্রধান পরিমাপক । কিন্তু তার সাথে আমাদের বুঝতে হবে যেমন করে জীবন যাত্রার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কিছু একে অন্যের ধারা প্রভাবিত, এবং তাদের মধ্যে কার্যকরণ সম্পর্ক রয়েছে। ঠিক তেমনি সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়নের সবগুলো সেক্টর বিবেচনার নিয়ে উন্নয়নবিদরা পরিকল্পনা করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হয়।
সুতরাং কোন অঞ্চলের রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা কিংবা সকল জায়গায় সেতু নির্মান দিয়ে আপনি উন্নয়নকে পরিমাণ করতে পারবেন না। উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীর নাগরিকদের মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে সিন্ধান্ত গুলো নেয়া হয়। কোন একটি সিন্ধান্ত কারো মতের বিপরীতে গেলেও বুঝতে হবে সেটার হয়তো অন্য কোন শ্রেণী-বিশেষের জন্য প্রধান্য দেয়া প্রয়োজন ছিল।
আবার আপনি যদি শুধু নিজের দেশের উন্নয়ন নিয়ে খুব চিন্তিত কিন্তু “অন্য দেশ গোল্লায় যাক” এরকম মানসিকতা পোষন করেন তাহলে আপনি বোকার রাজ্যে বসবাস করছেন! একটা উদাহরন হিসেবে বলা যায় আমাদের বস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানি। এর সারমর্ম হচ্ছে পৃথিবীতে বিদ্যমান পরিবেশের প্রত্যেক উপাদানসমূহ, জীব-জগত ও জড়-জগতের প্রত্যেকে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, একে অন্যে ধারা প্রভাবিত হয় এবং তারা পরস্পর নির্ভরশীল। প্রকৃতির এই নিয়ম মাফিক চক্রের মধ্যে প্রকৃতি ও মানুষ একে অন্যের সাথে বিভিন্নভাবে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে টিকে থাকে। কোন একটা বিষয় গড়মিল হলে তার দ্বারা বাকিরা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। আমার আলোচনা এই বিষয়ে না হলেও সামগ্রিক উন্নয়নের আন্তঃসম্পর্ক বুঝাতে উদাহরনা টা টেনে আনলাম।
সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বা টেকসই উন্নয়নের জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রকে নিয়েই চিন্তা করতে হবে। কারণ আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, ও পরিবেশগতভাবে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল এবং একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত।
আর এই বিষয় মাথায় রেখে জাতিসংঘ সকল দেশের সহযোগীতায় দেশসমুহ ও পরিবেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য তথাপি সকলের বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সহস্রাবদ্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলো। সেটার পরবর্তী ধাপ এখন “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” বা “এসডিজি” নির্ধারণ করেছে। এক কথায় বলতে গেলে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” হচ্ছে মানুষ ও পৃথিবীর সামগ্রিক মঙ্গল ও উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা।
“এসডিজি” তে সতের’টি বৃহৎ বিষয়ের উপর বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যা সকল দেশের জন্য প্রয়োজন, সবাই সেগুলো অর্জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
“টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” ও বাংলাদেশঃ
আমাদের অনেক কে বলতে শুনা যায় সরকার দেশটা অন্য দেশের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে বা কোন আরেকটা দেশের দালাল হয়ে গেছে ইত্যাদি। তাদের জ্ঞাতার্থে বলবো যে আপনার এই নবীন দেশের অনেক বিষয়ে সক্ষমতা নাইবা থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে অন্য দেশের সাহায্য নেয়া ছাড়া উপায় নাই। আবার একইভাবে অন্য দেশও অনেক কিছুর জন্য আমাদের দেশের উপর নির্ভরশীল। সেটারও খোজ রাখা প্রয়োজন মনে করি। পারস্পরিক সহযোগীতার মাধ্যমেই মানব জাতিকে টিকে থাকতে হবে। বিশেষ কোন একটা পণ্য যেমন ইলিশ বা চিংড়ি অন্য দেশে রপ্তানী করলে বা চুক্তির মাধ্যমে কোন সুবিধা দিলে বুঝতে হবে আমরাও তার বিপরীতে কিছু না কিছু পাচ্ছি, এবং বিভিন্ন দিক দিয়ে পাচ্ছি। আবার বিদেশে হাজার কোটি টাকার পোশাক রপ্তানী করছি। তার বানিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করে দিলে আমাদের দেশের পোশাক খাতে অনেক খারাপ প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতেও অন্যদের সাহায্য লাগতে পারে। আমাদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভিত্তিক কোন দেশ পন্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলে আমাদের দেশে টানাপোড়ন শুরু হয়ে যায়। সাম্প্রতিক পেয়াজের জন্য হাহাকারের বিষয়টা অনেকে অনুধাবন করেছেন! মনে রাখা জরুরী যে পৃথিবীটা লেন-দেন বা “গিভ এন্ড টেক” নীতির উপর চলে। এবং এটাই স্বাভাবিক! বানিজ্যিক সম্পর্ক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করা মানে দেশকে বিক্রি করে দেয়া নয় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। আমরা একদিকে ছাড় দিচ্ছি, কিন্তু অন্যদিকে হয়তো কয়েকগুন লাভবান হচ্ছি। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই এই চর্চা করে।
বৈশ্বিক শান্তি নিশ্চিতের অংশ হিসেবে উন্নত দেশগুলো সরাসরি কিংবা জাতিসংঘ এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্টান এবং দেশী-বিদেশী এনজিও মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নমূলক কাজে ব্যাপক সহযোগীতা করে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ ও তার সুফল ভোগ করছে। প্রতি বছর বিশাল পরিমান অনুদান আমাদের দেশে উন্নয়নের জন্য ব্যায় করা হয় সেটার খবর কয়জন রাখেন? জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিদেশী ও দেশী এনজিও গুলো জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন, অবকাঠামো নির্মান ও মানবাধিকার এর মতো বিষয়গুলোতে টেকসই উন্নয়ন অর্জনে প্রয়োজনীয় সেক্টরে সকল দেশের সরকার কে সহযোগীতা করে যাচ্ছে। এছাড়া শর্তসাপেক্ষে অনেক দেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশকে তার উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই যাতে সুন্দর ও শান্তিময় পৃথিবী প্রতিষ্ঠা হয় যেখানে সকল মানবিক ও প্রাকৃতিক চাহিদা পূরণ হবে এবং ভবিষ্যতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা অব্যাহত থাকবে। অপরদিকে যদি উন্নয়ন কর্মকান্ড যৌক্তিক পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন না হয় তবে সেটা টেকসই উন্নয়ন হবেনা। মানুষ ও প্রকৃতি স্বল্প মেয়াদে লাভবান হলেও ভবিষ্যত পজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই জাতিসংঘ ও সকল রাষ্টের সম্মিলিত স্বিদ্ধান্তে যে সতের’টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা নির্ধারন হয়েছে তা ঐতিহাসিক সিদ্বান্ত ছিলো।
এই “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এস ডি জি” ঘোষনার আগেই বাংলাদেশের লৌহ মানবী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়ন রুপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ ঘোষনা করেন যেখানে টেকসই উন্নয়নের উপরই জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সম্পদের স্বল্পতা ও সমবন্টনের সমস্যা প্রকট। বৃটিশ ও পাকিস্থানী শাসকরা এ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে রেখে গিয়েছিলো। সেখানে ৪৯ বছরে একটা দেশ সক্ষমতা অর্জন কখোনই করতে পারবেনা। কিন্তু বাঙ্গালিদের অসীম ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম ও সরকারের দুরদর্শী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আমাদেরকে অবিশ্বাস্যভাবে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”র অনেক সূচক অর্জনে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ এই টেকসই উন্নয়নের অনেক সূচকে ভারত ও পাকিস্থান থেকে এগিয়ে আছে। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা ও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনার বাংলাদেশ সরকার ১৭ টি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৩৯ টি সূচক কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে কাজ করে যাচ্ছে।
টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৬৬ টি দেশের মধ্যে ১০৯ তম অবস্থানে আছে এবং ভারত ও পাকিস্থান যথাক্রমে ১১৭ ও ১৩৪ তম স্থানে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের অগ্রসরতা বনাম প্রতিবন্ধকতাঃ
“টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা”য় যে ১৭ টি বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র বিমোচন, ক্ষুধা নিরসন ও খাদ্য নিরাপত্তা, সুস্বাস্থ্য ও কল্যান, গুনগত শিক্ষা, লিঙ্গভিত্তিক সমতা, পানি-স্যানিটেশনের সহজলভ্যতা, জ্বালানীর সহজলভ্যতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো-শিল্পায়ন ও উদ্ভাবন, অসমতা দূরীকরন, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলা, সঠিক নগরায়ন, পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন, সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও যথাযত ব্যাবহার, বস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র রক্ষা, টেকসই সমাজ ব্যাবস্থা ন্যায়বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত এবং টেকসই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাপী একযোগে কাজ করার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি বিষয় অনেক ব্যাপক এবং তার পরিমাপক সূচক ও অনেক যা এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এখন এটাকে যদি আমরা সামগ্রিক উন্নয়নের “আদর্শ পরিমাপক” হিসেবে মনে করি তাহলে আমাদের দেশের উন্নয়নের কয়টা বিষয় নিয়ে আমরা সাধারণ জনগণ ভাবি? বা কয়টা বিষয় নিয়ে আমরা আগ্রহ প্রকাশ করি সেটা মূখ্য বিষয়। সরকারকে কিন্তু সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করতে হয় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ বরাদ্দ করতে হয়।
আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশ এখানকার অনেকগুলো বিষয়ে আশানুরুপ অগ্রগতি অর্জন করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশি বিদেশি এনজিও গুলোও সরকারকে সহযোগীতা করে যাচ্ছে।
টেকসই উন্নয়নের আলোকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হিসেবে কিছু তথ্য দিবো এবং তার সাথে কিছু পিছিয়ে পড়া বিষয়ও তূলে ধরতে চেষ্টা করব।
চলতি বছরের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত শিক্ষাখাতে অর্জন হিসেবে সরকার ২৬ হাজার ১৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৬৮৫ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়া অবৈতনিক করা হয়েছে। আমাদের কাঙ্খিত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা ছিলো যুগান্তকারী প্রদক্ষেপ। শিক্ষায় ‘আই সি টি’র ব্যাবহার বেড়েছে। দেশে এবং বিদেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে পূর্বের তুলনায়, বাংলাদেশি গ্রাজুয়েটরা বিশ্বের নামী দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং তাদের ভর্তির সুযোগ বাড়ছে। রোবট ও ড্রোন তৈরীর মতো গবেষনায় সফল হচ্ছে! পৃথিবী বিখ্যাত গুগল, ফেসবুক, নাসা, মাইক্রোসফট এবং এমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে যাদের শিক্ষার ভীত বাংলাদেশেই গড়ে উঠেছে। আমাদের প্রবাসীরা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় দক্ষতার সাথে কাজ করছে এবং বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিক ও কর্মজীবীদের চাহিদাও অনেকাংশে বেড়েছে।
তথ্য ব্যাবস্থাপনায় দেশকে ডিজিটালের পথে নিয়ে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। সারা দেশে প্রতিটি উপজেলাকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনা হয়েছে, জনগণকে সহজে সেবা প্রদানের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করে কেন্দ্রীয় একটি তথ্য বাতায়ন বা পোর্টালের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। অনেক সেবা নাগরিকরা ঘরে বসেই পাচ্ছেন। কিন্তু ডিজিটাল সেবাগুলো এখনো সম্পূর্ণ কার্যকর হয়নি এবং এতে আরো গুনগত মান যুক্ত করা প্রয়োজন।
এদিকে নারী-কিশো্র-কিশোরী এবং শিশুদের অধিকার অনেকাংশে প্রাধান্য পাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে, দেশে বিপূল সংখ্যক নারী উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছে যা আমাদের জন্য আশার বানী। তার সাথে পুরুষ উদ্যোক্তার সংখ্যাও দিন দিন রাড়ছে। কৃষি উদ্যোগ এবং অনলাইন ব্যাবসার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নিরাপদ পয়োঃনিষ্কাশন উন্নত হলেও নিরাপদ পানির ঘাঠতি শহর অঞ্চলে রয়ে গেছে যদিও গ্রাম বা মফম্বলে পানির ঘাঠতি পরিলক্ষিত হয়না। এক্ষেত্রে এনজিও রা ভালো অবদান রাখছে সরকারের পাশাপাশি।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ নজরকাড়া অগ্রগতি লাভ করছে। ১৯৭৩ সালে মাথাপিছু আয় মাত্র ৭০ মার্কিন ডলার নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের মাথা পিছু গড় আয় এখন প্রায় ১৯০৯ মার্কিন ডলার। ১৯৭৩ সালে যেখানে আমেরিকার একজন অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন নবীন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৭০ থেকে ৯০০ ডলারে নিয়ে যেতে ১২৫ বছর প্রয়োজন হতে পারে!
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ হাজার ২০৯ কোটি টাকারও বেশি যেখানে পাকিস্থানের রিজার্ভের দ্বিগুন এবং শ্রীলংকার চেয়ে প্রায় আট গুন বেশি।
বেশ কিছু ঐতিহাসিক নীতিমালা বাংলাদেশ গঠন করেছে। উল্ল্যেখযোগ্য শিক্ষানীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, শিল্পনীতি, বানিজ্যনীতি, তথ্য অধিকার আইন, সড়ক নিরাপত্তা আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ইত্যাদি জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
বাংলাদেশের মাঠিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে যা জাতি হিসেবে আমাদের কলঙ্কমুক্ত করেছে।
টেকসই উন্নয়ন ও সামগ্রিক উন্নয়নের ভালো দিক অনেক দেখা হলো, তার মানে কি আমরা টেকসই উন্নয়নের দিকে শুধু উন্নতি করেই যাচ্ছি? উত্তর হচ্ছে “না”! বেসরকারী গবেষনা সংস্থ্যা “সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ” এর একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দাবী করে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” অর্জনে সঠিক পথে নেই বাংলাদেশ! এর কতোটা গ্রহনযোগ্যতা আছে তা নিয়ে ধারণা নেই। কিন্তু আমার মতে কিছু বিষয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি এটা সত্য।
বিশেষ করে বৈষম্য দূরীকরণ, লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত, বিচার প্রক্রিয়ার গতিশীলতা, অভ্যন্তরীন শান্তি নিশ্চিত, পরিবেশ রক্ষার মতো বিষয়গুলোতে আরো নজর দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধি, জীবনমুখী শিক্ষা ও উদ্ভাবনের প্রসার, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো নিয়ে বেশি ভাবা উচিত।
অপরদিকে এসব অনগ্রসরতার পিছনে সীমাহীন দূর্নীতি, দক্ষ জনবলের অভাব, সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে দক্ষ ব্যাবস্থাপনার অভাব রয়েছে। দূর্নীতির প্রশ্নে সরকারকে আরো জোরালো অবস্থান নিতে হবে মনে করি। তার সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে জনগণের সচেতনতা ও সহযোগীতার অভাব। একটা দেশের জনগণ যদি সরকারকে সহযোগীতা না করে এবং নিয়ম মেনে না চলে তবে সেখানে উন্নতির পথ বার বার বাধাগ্রস্থ হবে। গত কয়েকদিন পুর্বে শুনলাম বাংলাদেশের জনগণের শতকরা মাত্র এক ভাগ লোক আয় কর প্রদান করে যা বাস্তবতার নিরিখে অস্বাভাবিক বটে! তার সাথে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যাবহার, রাজনৈতিক অস্থিরতা এসব কারন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রার পথে রিরাট অন্তরায়।
উন্নয়নের জন্য চাই সক্ষমতা ও নাগরিক সহযোগীতাঃ
আমাদের দেশের বিশাল পরিমান জনগোষ্টির যৌক্তিক চিন্তা, মেধা ও জ্ঞান চর্চার বড়ই অভাব রয়েছে। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স) এর ২০২০ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশ ১৩৮ টি দেশের মধ্যে ১১২তম স্থানে রয়েছে এবং দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। এই সূচক মুলত শিক্ষা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও সৃজনশীলতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয়।
এটা থেকে স্পষ্ট যে আমরা দেশ হিসেবে বা নাগরিক হিসেবে শুধু জ্ঞান বিতরণ করতে পটূঁ, অন্যের ভূল বা সরকারের সমালোচনায় মুখরিত থেকে নিজেদের মেধা ও মননের উন্নয়ন ঘঠাতে পারছিনা। একটি দেশে যখন অধিকাংশ নাগরিক প্রত্যেক সেক্টর ভিত্তিক কাজে দক্ষতা ও যৌক্তিক চিন্তার অধিকারী হয়ে উঠে তখন সে দেশ উন্নত হবে দ্রুততার সাথে। আমার মতে নাগরিকদের উন্নত মন মানসিকতার বিকাশ উন্নত রাষ্ট্র গঠনের একটি পূর্বশর্ত!
পরিশেষে বলবো পৃথিবীর কোন দেশে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অস্থিরতা বিদ্যমান থাকলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়, আবার টেকসই উন্নয়ন ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব।
সেজন্য রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার, সাধারণ নাগরিক, দেশী-বিদেশী বেসরকারী সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রমই পারে দেশকে দ্রুত কাঙ্খিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে। অস্থিতিশীলতা, ধর্মীয় বিষঃবাষ্প ছড়ানো সহ দূর্নীতি ও বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার মতো ক্ষতিকর বিষয়সমূহের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আমি আশাবাদী বাংলাদেশ একদিন পূরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে!
এটাই হোক ৪৯ তম বিজয় বার্ষিকীর অঙ্গীকার!
লেখকঃ
এম. ইসলাম মিছবা
উন্নয়ন কর্মী ও সামাজিক বিশ্লেষক
ইমেইলঃ muhibul.misba@gmail.com
সীমান্তবাংলা/ প্রকাশঃ ২০ ডিসেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।