বাবা মানেই-মাথার উপর এক টুকরো ছাদ, মাথার উপর বিশাল এক আকাশ!

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২০

 

দু’ অক্ষরের পৃথিবীর তাবৎ শব্দের মধ্যে সবচেয়ে আদর, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, নির্ভরতা, আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হচ্ছে বাবা নামক অক্ষর যুগল। বাবা হচ্ছেন-একটি পুংলিঙ্গ শব্দ, যার অর্থ সন্তানের জনক, অভিভাবক, জন্মদাতা, বাবা, আব্বা ও পিতা। পৃথিবীর সকল বাবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই। আসলেই বাবা মানেই খুবই আপনজন, বাবা মানেই নির্ভরতা, বাবা মানেই, বাবা মানে গ্রীস্মের প্রখর রোদে এক পসলা বট বৃক্ষের ছায়া। অন্ধকারের পথের আলোর দিশা। বাবার বুক পরম নির্ভরতার যেখানে এক নিমিষেই পৃথিবীর সব ভয় জয় করে নিতে পারে আপন সন্তান। অনেক আদর, একটু শাসন, আশ্রয় প্রশ্রয় মমতায় মাখা বাবার বুকে আগলে রাখেন পরম আরাধ্য ধনকে।

বাবা শব্দের সমার্থক শব্দ- জার্মান ভাষায় ’ফ্যাটায়া’, ড্যানিশ ভাষায়;’ফার’, আফ্রিকান ভাষায় ‘ভাদের’ চীনা ভাষায় ‘বা’, কানাডিয়ান ভাষায় ‘পাপা’ আবার ইংরেজি ভাষায় ‘ফাদার’, ড্যাড,’পাপা’ ‘পাপ্পা’ ’বা ‘পাপা’, ক্রোয়েশিয়ানরা বলে ’ওটেক’, ব্রাজিলিয়ান ও পর্তুগিজ ভাষায় ‘পাই’, দাচ ভাষায় ‘পাপা’, ‘ভাডের’ ও ‘পাপাই’, ফিলিপিন ভাষায় ‘তাতেই’ ‘ইতেই’ এবং হিব্রু ভাষায় ‘আব্বাহ’, হিন্দী ভাষায় ‘পিতাজী’ ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় ‘বাপা’ জাপানী ভাষায় ‘ওতোসান,’পাপা’ ইত্যাদি। যে যেভাবেই ডাকুক না কেন বাবা বাবাই, বাবার কোন তুলনা হয় না। বাবা মানেই মাথার উপর এক টুকরো ছাদ, মাথার উপর বিশাল এক আকাশ!

একটি মানব শিশু ভুমিষ্ট হবার পর যে শব্দগুলোর সবার আগে তার মুখ থেকে বেরিয়া আসে তার অন্যতম হচ্ছে বাবা। এ যেন সন্তানের কাছে চিরন্তন আস্থার প্রতীক। শিশু যখন বাবা উচ্চারন করতে শেখে, তখন বাবার মন পুলকে উঠে, বাবার হাস্যোজ্জ্বল সেই অনুভূতি অবুঝ শিশুর হ্রদয়কেও আন্দোলিত করে। বাবা একতি ছোট্ট শব্দ হলেও এর ব্যাপকতা বিশাল। ডাকটার মাঝেই লুকিয়ে থাকে কী গভীর ভালবাসা, নিরাপত্তা ও নির্ভরতা। একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিকবার উচ্চারন করতে হয় যে শব্দগুলো তার মধ্যে বাবা অন্যতম। যার কারনে এই পৃথিবীর রঙ, রুপ ও আলোর সংস্পর্শে সেই বাবা শব্দটির সংগেই অপার স্নেহ আর মমতার মিশেলে এক দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে থাকে সন্তান। বাবাই সন্তানকে দেন ভরসা, জীবনে চলার পথে দেন বলিষ্ট সাহচর্য, দেন সঠিক পথের দিশা, ভাল কাজে দেন অনুপ্রেরণা, দেন জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ছবক। জন্মের পর থেকেই যে মানুষ্টি তার নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালবাসা আর দায়িত্বশীলতার শৃংখলে বেঁধে সন্তানের জন্ম, বেড়ে উঠাকে নিরাপদ ও সুন্দর রাখতে চায়, তিনি হলেন বাবা। সন্তানকে স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ করার স্বপ্ন-সাধনাই যে মানুষ্টির জীবনের প্রধান ব্রত হয়ে দাঁড়ায় তিনি হলেন বাবা। বাবার আদর আহ্লাদে হাজারো স্মৃতি নিয়ে বেরে উঠে সন্তান, বাবার হাত ধরেই ছোটবেলায় দর্শনীয় স্থানসমুহে ভ্রমণ করে পৃথিবীকে চেনে।

হযরত আদম (আঃ) মানুষের আদি পিতা, খ্রীষ্টান ধর্মে ঈশ্বরকে পিতা বিবেচনা করা হয়। খ্রীষ্টান সম্প্রদায় গীর্জার পুরোহিত মহাশয়কে সচরাচর ‘ফাদার’ বা পিতা হিসেবে সম্বোধন করেন। পিতার সেবা ও পরিচর্যা সুখকর। পিতাই ধর্ম, পিতাই স্বর্গ এবং পিতাই পরম তপস্যা, পিতা প্রীত হলে সকল দেবতা প্রীত হন’। বাবাহীন জীবন ধূসর মরুর ঊষর বুক, শ্বাপদ সংকুল বনে দুরু দুরু হ্রতকম্পনঃ বাবাহীন জীবন ছোট্ট ডিঙ্গি নিয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়ার দুঃসাহসিক চেষ্টার নাম। বাবার আদর্শ, বাবার সততা, বাবার নৈতিকতা সন্তানকেও প্রভাবিত করে। সাহিত্য, গীত, কবিতা, আনন্দ ও লোককথা শিল্প কর্মে বাবা স্থান করে নিয়েছেন এক দায়িত্বশীল স্নেহময় পুরুষ হিসেবে।
সদ্যজাত সন্তান বুকে নিয়ে বাবার যে সুখ অনুভব তা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম জিনিস, সবচেয়ে ভালোলাগার মুহুর্ত। সন্তান কোলে বাবার ভালোবাসায় যেন বেহেশতি সুখ। সন্তানের মুখে হাসি দেখলেই একজন বাবা হয় পৃথিবীর শেষ্ঠ একজন সুখী মানুষ।পরম বন্ধু বাবার হাত ধরেই বেচে থাকার মানে একটু একটু করে বুঝতে শেখা। তবে এ পরম বন্ধুত্বের কোথায় যেন ছড়িয়ে আছে খানিক গাম্ভীর্যের মেঘ, কিন্তু ঐ মেঘেই ধরা দেয় পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য। বাবা সন্তানকে শিশুকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সাহায্য করেন, সন্তানের মুখে হাসি ফুটাতে আত্মত্যাগ করেন, সুস্থ ও সবল রাখতে যত্ন করেন, সম্মানিত ও দক্ষ যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়তে খরচ করেন, বিপদে-আপদে পাশে থেকে উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করেন, প্রেমময় মণোযোগে যুক্ত রাখেন, সন্তানের মংগলে পেরেশান থাকেন, আবেগ গত চাহিদাগুলো পূরনে আন্তরিক থাকেন, সহমর্মী হন ও অনুভূতি বুঝতে আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। বাবা আছেন তো সন্তান অভাবহীন, চিন্তাহীন ও ভাবনাহীন। বাবা থাকলে সকল চিন্তা বাবা নিয়ে নেন, কোনো ভয়ই কাজ করেনা। ভীষন বড় বড় অপরাধ ক্ষমা করে কাছে টেনে নেন বারবার। সন্তানকে সন্তানের মতো মেনে নিয়েই ভালোবাসেন। বাবাই শিখান মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়,মানবিক গুনাবলীই মানুষের আসল পরিচায়ক।

সন্তানের দুঃসময়ে বাবা ডেকে নিয়ে বুকে চেপে রাখেন, চেষ্টা করেন সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেয়ার। হাজার কষ্ট সয়ে তিলে তিলে সন্তানকে বড় করেন একজন বাবা। ছোট বড় অখ্যাত সকলের কাছেই বাবা অসাধারণ। বাবার স্নেহ ভালবাসা সকলেরই প্রথম চাওয়া আর পাওয়া। একজন আদর্শ বাবা তার সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়ে পারেন না। বাবা সারাটা জীবন সংসারে চরম কষ্ট হাসিমুখে স্বীকার করে যান, পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে। সবকটি বিপদে বুকে আগলে রাখেন নির্ভীক নাবিকের মতো। চাঁদনী রাতে বাবা তাঁর আপন সন্তানকে কোলে নিয়ে চাঁদের বুড়ির গল্প শোনান। কখন ও রাক্ষস আর ডাইনীর গল্প শোনান। প্রত্যেক বার বাবার কাছেই নিজের মেয়েটা যেন রাজকন্যা, আর ছেলেটা রাজপুত্র। সে সুন্দর হোক বা কালো হোক বা কুৎসিত হোক।
বাবাকে নিয়ে কিছু গল্প রয়েছে এমন যে- ‘বাবার শার্টগুলো বেশিরভাগ সময় মা-দের শাড়ি থেকে দামি হয়না’, ‘বাবাদের ওয়ারড্রব ভর্তি শার্ট প্যান্ট থাকেনা’। ‘বাবাদের জুতা চলে বছরের পর বছর’, ‘মোবাইলটা একেবারে নষ্ট না হলে যেন বদলায়না’, ‘ঘড়িটা বৃদ্ধ হয় তবুও হাতে থাকে’, ‘একা খেতে হলে বাবা সবচেয়ে সস্তা হোটেল খুঁজেজেন। ’একা কোথাও গেলে বাবা বাসে চড়েন’।

বাবাই রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সঞ্চয় করেন শুধুমাত্র পরিবারকে নানাবিধ প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু স্ত্রী সন্তানদের সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে দামী জিনিসগুলো কিনে দেন। আবার বাবারা একান্ত বাধ্য না হলে না বলতে জানেন না। নিজের জন্য সবচেয়ে কৃপণ বাবাটা তার স্ত্রী, সন্তানের জন্য বেশি বেহিসাবি। বেশির ভাগ বাবাই ভালবাসি শব্দটা বলতে জানেন না, করতে জানেন। বাবারা আজীবন তাদের ভাগের বিলাসিতার ভাগ দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের ভালবেসে যান। পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ পুরুষ আছেন, অসংখ্য খারাপ জন্মদাতাও আছেন কিন্তু ‘একজন খারাপ বাবা নেই’।

বাবা শুধু মানুষ নন, স্রেফ একটি সম্পর্কের নাম ও নয়-বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুদ মায়াবি প্রকাশ। বাবা নামটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথে যে কোন বয়সী সন্তানের হ্রদয়ে খেলে যায় মায়াবী এক রাশ শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসার এক অনুভব! বাবার কাঁধটা কি অন্য সবার চেয়ে বেশু চওড়া? তা না হলে কি করে সমাজ সংসারের এত দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়ান বাবা নামক সর্বংসহা প্রাণিটা? বাবার ‘পা’ কি অন্য সবার চেয়ে বেশি দ্রুত চলে? না হলে এতটা বন্ধুর পথ এত অল্প সময়ে কি করে মাড়ি দিয়ে এত শক্ত করে সব কিছু আগলে রাখেন বাবা? আবার বাবার ছায়া…? মধ্য দুপুরের পর যখন শেষ বিকেলের দিকে সূর্য ছুটে, সেই সময়ের বটগাছের ছায়ার চেয়ে বিশাল। বড় যদি না হবে, জীবনের এত উত্তাপ থেকে কি করে সন্তানকে সামলে রাখেন বাবা আর বাবার চোখ? সেটাও কি দেখতে পায় কল্পনার অতীত কোনো দুরত্ব! তা না হলে কি করে সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনায় শংকিত হন বাবা?
বাবা নিয়ে সব সন্তানের অনুভুতি সমান হয়না আবার সব বাবাও পারেননা সন্তানের প্রতি তাদের আবেগকে একইভাবে প্রকাশ করতে। বাবা সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করে যান তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত!

প্রকাশভংগী যাই হোক সন্তানের জন্য পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকেনা বাবার। তাই বলি-বাবা মানে-গ্রীস্মের প্রখর রোদ্রে ক্লান্ত পথিকের এক পসলা বট বৃক্ষের অমৃতসম ছায়া। ধন্যবাদ সবাইকে।

এম আর আয়াজ রবি

লেখক, কলামিষ্ট ও মানবাধিকার কর্মী