এক হাজার টাকা কৃষিঋণে কেউ জেলে, ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি সরকারের পাশে:ফরাসউদ্দিন

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: মে ২, ২০২৪

অল্প ঋণখেলাপি ব্যক্তিরা জেলে যায় আর বেশি ঋণখেলাপিরা সরকারের পাশে বসে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি ঊষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘যখন ঋণ খেলাপিওয়ালা বেশি বড় হয়ে যায়, তখন এক হাজার টাকা কৃষিঋণের কারণে কেউ জেলে যায়, আর ১০ হাজার কোটি টাকা শিল্পঋণের খেলাপি গ্রাহক সরকারের পাশে বসে। এখন যে যত বেশি শক্তিমান, সে তত বড় খেলাপি। তার সুদ মওকুফও হয় তত বেশি।’

ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘বছরে ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ে কেউ কিছু বলে না। সরকার নিশ্চুপ, রহস্যজনকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ নিয়ে কিছু বলে না। ঋণখেলাপি, করখেলাপি ও অর্থ পাচারকারী এক সূত্রে গাঁথা। তারা যখন দেখবে শাসককুলের চক্ষু লাল হয়ে গেছে, তখনই তারা টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করবে। তার আগে নয়।’

অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এসব বলেন। এ সময় তিনি দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, ব্যাংক একীভূত করা, টাকা ও ডলারের সংকট, বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নেরও জবাব দেন সাবেক এই গভর্নর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফে সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মৃধা। সঞ্চালক ছিলেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘২০০৩ সালে সুদ মওকুফ শুরু হয়। আমার কাছে ক্ষমতা থাকলে সুদ মওকুফ সুবিধা এখনই বন্ধ করে দিতাম। আর যখন শক্তিমান কেউ সরকারকে বোঝাতে পারবে, মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায় খেলাপি ঋণ আদায় করা। এখন কে বোঝাবে, এটা একটা বিষয়। সরকার সেটা শুনলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’

ব্যাংক একীভূতকরণ প্রসঙ্গ

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ব্যাংক একীভূত করা সব দেশেই হয়। জোর করে ব্যাংক একীভূত করা যাবে না। দুই পক্ষের সম্মতিতে এটা করতে হবে। কিন্তু খারাপ ব্যাংক ভালো করার এটাই একমাত্র উপায় না। এর বিকল্প আছে। এখন যাদের ভালো ব্যাংক বলা হচ্ছে, এমন চারটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকই একসময় তদারকি করে ভালো করেছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ নিয়ে উৎকণ্ঠা আছে। অথচ বিদেশে অহরহ ব্যাংক বন্ধ হচ্ছে। এ জন্য আমানত বিমার পরিমাণ এক লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা দরকার। তাহলেই আমানতকারীরা ভরসা পাবে। টাকা ঘরে না রেখে ব্যাংকে রাখবে। পাশাপাশি ৩-৬ মাস মেয়াদি আমানত ব্যাংকে আনতে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে দেওয়া উচিত। টাকা-ডলার অদলবদল কোনো ভালো পন্থা না।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, একমাত্র সরকারি ব্যাংক হিসেবে বেসিক ব্যাংক একসময় সরকারকে মুনাফা দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা তৈরি করা। ধীরে ধীরে ব্যাংকটি খারাপ করে ফেলা হয়েছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সৃষ্টি করা হয়েছিল উত্তর বাংলার কৃষিকে জোরদার করার জন্য। এখন এক করা হলে উত্তর বাংলার কৃষি বেকায়দায় পড়তে পারে। বিডিবিএলকে একীভূত করা ঠিক হবে না। প্রকল্প ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকটির প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা ভেবে দেখতে পারে।

তিনি আরও বলেন, হুট করে ব্যাংক একীভূত করা ঠিক হয়নি। অশোভনীয় হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংককে যতই একীভূত করা হোক, সেটা ভালো হবে না। ওই ব্যাংক যিনি নষ্ট করেছেন, শুনেছি দেশেই আছেন। আগে ওনার নাম ভিন্ন ছিল, পরে ‘শেখ’ হয়েছেন। কার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আছেন জানি না। জানলেও নাম বলতে পারতাম না। কারণ, এই বয়সেও আমি ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’।

অন্য একটি ব্যাংকের নাম উল্লেখ না করে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাকে ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল। তার ছেলে জনসম্মুখে একটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা কত টাকা যে বিদেশে নিয়ে গেছে, তার হিসাব নেই। এই ব্যাংক একীভূত করে, না আলাদা রেখে শায়েস্তা করা হবে, এটা সিদ্ধান্তের বিষয়। একীভূত করা ভালো সিদ্ধান্ত, তবে এটা নতুন করে সংকট তৈরি করতে পারে।

খেলাপি ঋণের কারণে অর্থসংকট

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সারা পৃথিবীতে তফসিলি ব্যাংকের কাজ হলো ৩-৬ মাস মেয়াদে বাণিজ্য অর্থায়ন করা। ১৯৯১-৯২ সালে একটি মুরব্বি দাতা সংস্থার পরামর্শে সরকার ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন শুরু করায়। এটা ভালো পরামর্শ ছিল না। এ জন্য ব্যাংক খাতে সমস্যা শুরু হয়। খেলাপি ঋণ শুরু হয় ওই সময় থেকে।

প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক খাতে সব গ্রাহকেরা আমার সময়ে নিয়ন্ত্রণে ছিল। নিশ্চয়ই আবার নিয়ন্ত্রণে আসবে। খেলাপিরা ২ শতাংশ টাকা দিলে নিয়মিত হয়ে যায়, অন্যদের দিতে হয় ১০ শতাংশ। নির্বাচনের আগে এই সুবিধা এক বছর বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সংসদে ব্যাংক পরিচালক মেয়াদ ৯ বছর প্রস্তাব গেল, কোনো সুপারিশ ছাড়াই তা হয়ে গেল ১২ বছর। এর জবাব কী।’

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় খেলাপি ঋণের পুনঃ পুনঃ পুনঃ তফসিলের কারণে ব্যাংক খাতে অর্থের টান পড়েছে। এ জন্য টাকা ছাপিয়ে বা ট্রেজারি বন্ডে দিতে হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি থেকে যাচ্ছে। যখন শক্তিমান কেউ সরকারকে বোঝাতে পারবে, মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায় খেলাপি ঋণ আদায় করা। এখন কে বোঝাবে, এটা বিষয়। সরকার সেটা শুনলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘আমার সময়ে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া মতো পরিস্থিতি হয়নি। আমার সময়ে ৫টি দুর্বল ব্যাংককে বিশেষ ব্যবস্থায় সংকট থেকে বের করে আনা হয়েছিল। আর যখন কোন অপরাধের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কাউকে শাস্তি দেয়, তখন সংস্থাটির মর্যাদা বাড়ে।’

বৈষম্য কমবে কীভাবে

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি কিষান-কিষানি। তবে বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি যখন দ্রুতগতিতে বড় হয়, তখন দয়া-মায়া কমে যায়। ৩০ বছর আগের গরিব আর এখনকার গরিবের ধরন এক নয়। তবে তখনকার ধনী আর এখনকার ধনীর মধ্যে ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে। এটা কমানো সম্ভব। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

তিনি বলেন, রাজনীতিবিদেরা যদি সিদ্ধান্ত নেন, বৈষম্য কমাতে চান, তাহলে অর্থনীতি সেই পথে যাবে। শিল্পায়নের মডেল অনুসরণ করে বড় শিল্প, মাঝারি শিল্প ও কুটির শিল্প করতে হবে। এ জন্য মুদারাবা ব্যাংকের আদলে বিশেষ তহবিল করতে হবে। এখন ৩৯ লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছে, তাদের টাকা দেওয়া হবে, যা ফেরত না দিলেও কোনো সমস্যা নেই। এতে বৈষম্য কমবে, কর্মসংস্থান হবে ও দারিদ্র্য কমে আসবে। বাংলাদেশের অর্থ বছর জুলাই-জুন না করে জানুয়ারি-ডিসেম্বর সময়ে করা উচিত। এতে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হবে।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর খুব কম দেশের একটি, যার জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখনো নেতিবাচক হয়নি। এমনকি করোনার মধ্যে যে ১৭ দেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আবার বাংলাদেশ খুব কম দেশের একটি, যে ভূরাজনৈতিকভাবে মোটামুটি ভারসাম্য ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। খুব বেশি ভারসাম্য ধরে রাখা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে কারও পকেটে বা প্যাকেটে ঢুকে যায়নি।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমি মনে করি কোনো আমলার রাজনীতিতে আসা ঠিক না। কোনো গোষ্ঠীর আখের গোছানোর জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। স্বাধীন হওয়ার সুবিধা কেউ পাচ্ছেন অতি সামান্য, কেউ অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছেন। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা অনেক ভালো করেছেন, তাঁদের এখন যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। বেসরকারি খাত ধনদৌলতে বড় হলেও কর্মসংস্থান সরকারি খাতকেই করতে হবে।’

সংকট যেখানে

কয়েকটি ব্যাংক প্রায় দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না, অথচ তারা ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে। আবার টাকা ও ডলারের সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এর জবাবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বিধিবিধান, রীতিমতো আইন না মানলে সমস্যা তো হবেই। টাকাকে অতিমূল্যায়িত রাখা ঠিক হচ্ছে না। অনেকে পরামর্শ দেন, টাকার মান বেশি থাকলে ভালো হয়। এটা ভুল ধারণা। ডলারের একাধিক বিনিময় হার থাকা উচিত নয়। এতে লাভবান হয় শুধু মধ্যস্বত্বভোগীরা।

ব্যাংকিং খাতে বড় বড় গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন? মূল্যস্ফীতি কেন কমাতে পারছি না, অনেক দেশ তো পেরেছে? এর জবাবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘গত ১৫ মাসে অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি অর্ধেক কমিয়ে এনে ৫ শতাংশে এনেছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ। বাজার তদারকি করতে হবে টিভি ক্যামেরা ছাড়া। ভোজ্যতেলের কয়েকজন আমদানিকারককে সোহাগ না করে কিছুদিন শাসন করতে হবে। পাশাপাশি গুটিকয় আমদানিকারকের পরিবর্তে আমদানিকারক বাড়াতে হবে। এতে উপকার পাওয়া যাবে।’

এ সময় মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘আমদানিতে অনেক মধু। এই মধু তারা অনেকের সঙ্গে ভাগ করে। এ জন্য আমরা আমদানি থেকে বের হতে পারছি না। আমরা কি ফার্নিচার, ঘড়ি, গুঁড়ো দুধ তৈরি করতে পারি না। প্রশ্ন রাখেন তিনি।’

বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতায়ন

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, গত ১৫-১৬ বছরে ব্যাংকিং খাতের পরিধি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আমানতের পরিমাণ ও ঋণ বিতরণও দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জনবল ও ক্ষমতা বাড়েনি। আমরা ২০০০ সাল থেকে সুপারিশ করে আসছি বাংলাদেশ ব্যাংককে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য। গভর্নরকে ছয় বছরের জন্য নিয়োগ সুপারিশ করেছি। এতে স্বাধীনতা বাড়বে। নিশ্চয়ই এটা একদিন হবে।

তিনি বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক সংস্কার কমিশনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। যদি শক্তিশালী বাংলাদেশ ব্যাংক ও দক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয় থাকে, তাহলে ব্যাংক সংস্কার কমিশনের প্রয়োজন নেই।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ সমালোচনায় একটা ফ্যাশন দেখা যায়, সবাই বলে এত ব্যাংক ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। ব্যাংকের সংখ্যা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা শাখার সংখ্যা। বাংলাদেশের ব্যাংকের একটি শাখা ১৫ হাজার লোককে সেবা দেয়। ভারত ও শ্রীলঙ্কা ব্যাংকের একটি শাখা ১২ হাজার জনকে সেবা দিয়ে থাকে। এমন ব্যাংক শাখা আরও হতে পারে। কিন্তু আমানত যদি ৬০ ভাগ হয় মতিঝিলে আর বাকি অংশ গ্রাম থেকে আসে। আর ঋণের ৬০ ভাগ চলে যায় চট্টগ্রাম, মতিঝিল ও নারায়ণগঞ্জে। তাহলে এটা সমস্যা। এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।’ তিনি বলেন, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে যে সংকট হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় দুর্বলতা ছিল।

সংবাদটি শেয়ার করুন