রাজাকারের তালিকা: বিতর্ক তুঙ্গে

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯

রাজাকারের তালিকা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তুঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীসহ বেশ কিছু নাম আসায় প্রকাশের দিন থেকেই বিতর্ক শুরু হয়েছে চার দিকে। ক্ষুব্ধ, সংক্ষুব্ধ তালিকায় নাম আসা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, সংগঠকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন এই তালিকা নিয়ে। তীব্র সমালোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনেও। রোববার প্রথম পর্বে মুক্তিযু্‌দ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০৭৮৯ জন রাজাকারের নাম প্রকাশ করে। তালিকায় মুুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসায় গতকাল মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অভিযোগের পরিমান বেশি হলে তালিকা প্রত্যাহার করে নেয়ার চিন্তা করা হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম তালিকায় আসায় ক্ষুব্ধ ট্রাইব্যুনালের অন্য প্রসিকিউটররা। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে টিপু বলেন, তিনি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তালিকায় তার নাম আসায় তিনি বিস্মিত। এটি সংশোধন না হলে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেয়ার কথাও জানান তিনি।

মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ: রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, সদ্য প্রকাশ হওয়া তালিকায় ভুল বেশি হলে তা প্রত্যাহার করা হবে। গতকাল বাংলাদেশ শিল্পকবলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, একাত্তরে প্রস্তুত করা তালিকাটিতে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংযোজন করে থাকতে পারে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তালিকা পেয়েছি, হুবহু তা প্রকাশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সে সময়ের সরকারি রেকর্ড দিয়েছে, নতুন তালিকা করেনি।

মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯৭১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত রাজাকারদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকা আগেই তৈরি করে রেখে গেছে। সেখানে কোনো ইল মোটিভ থাকতে পারে, উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। যেভাবে আছে, সেভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এটা এডিট করি নাই, দাঁড়ি-কমা, সেমিকোলন চেঞ্জ করি নাই। মন্ত্রী বলেন, আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, এই তালিকা আমরা তৈরি করি নাই। জাতির দাবি ছিল, তাই প্রকাশ করেছি। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তৈরি করি নাই। এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইবেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দুঃখ প্রকাশ করা ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে তো কোনো পার্থক্য নাই। নিঃসন্দেহে এটা ক্ষমার চোখে দেখবেন। মোজাম্মেল হক বলেন, ভুলের দায় এড়াতে পারি না। যেসব অভিযোগ পাব, যাচাই করে সেসব নাম প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ভবিষ্যতে তালিকা প্রকাশের আগে যাচাই-বাছাই করে পরে প্রকাশ করা হবে। বর্তমান তালিকায় ভুল-ভ্রান্তি বেশি থাকলে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।

রাজাকারের তালিকা প্রকাশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘নোট বিবেচিত হয়নি’: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাজাকারের তালিকা সরবরাহের সময় প্রত্যাহার হওয়া নাম-মামলার বিষয়ে ‘নোট’ দেয়া হলেও সেগুলো বিবেচনা না করেই প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই নোটগুলো বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কৃষক লীগের এক আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে দালাল আইনে বিবাদীদের লিস্ট আমরা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আমরা উইথড্রগুলোর নোট দিয়েছিলাম। সেটা তালিকায় যাথাযথভাবে আসেনি। আশা করি, তারা যাথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে তা প্রকাশ করবে।

মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: ওদিকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় ভুলভাবে কারও নাম এসে থাকলে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গতকাল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো ‘রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিকমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর ব্যাখ্যায় এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, গত ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কোনো তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ তালিকায় বেশ কিছু নাম এসেছে, যারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটি বা স্বাধীনতাবিরোধী নন, বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ ধরনের কোনো ব্যক্তির নাম তালিকায় কিভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রকাশিত তালিকায় ভুলভাবে যদি কারও নাম এসে থাকে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই অন্তে তার/তাদের নাম এ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। অনিচ্ছকৃত ভুলের জন্য মন্ত্রণালয়ের তরফে দুঃখ প্রকাশ করা হয় সিনিয়র তথ্য অফিসার সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।

তদন্ত দাবি বিশিষ্টজনদের: গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা, বেশ কয়েকজন সুপরিচিত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় বিস্মিত বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, এর তদন্ত হওয়া উচিত। কেউ দায়ী হলে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, যারা এই তালিকা তৈরি করেছেন এটা তাদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার প্রমাণ। আজকাল বেশিরভাগ কাজে দলীয় পরিচয় অন্যতম প্রধান যোগ্যতা। এখানে আসল যোগ্যতা গৌন হয়ে গেছে। এ জন্য এসকল বিভ্রাট ঘটছে। আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এ বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটাও অদক্ষ এবং অযোগ্যতার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। এই তালিকাটি সম্পূর্ণ পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার উপর নির্ভর করে করা হয়েছে। ফলে এখানে বিভ্রাটতো ঘটবেই।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আট মাস জেল খেটেছেন। আজ তিনি রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা কেন এমন হল তার তদন্ত করা দরকার। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত করা উচিত। এরকম ভুল তথ্য দিয়ে জাতিকে কেন তারা বিভ্রান্ত করছে। এটা কিছুতেই গ্রহণ করা যায় না। একাত্তরের পরে কার কি ভুমিকা ছিল বাংলাদেশে। রাজাকার, আলবদর কারা ছিল তার তালিকা সঠিকভাবে তৈরি করা দরকার। এমনভাবে তৈরি করা উচিত হবে না যেটা ভুল হবে। এবং সমাজে একটি বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।

শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এটা একটি হাস্যকর ব্যাপার। প্রকৃত রাজাকারদের বাঁচাতে এটি ইচ্ছাকৃত ভুল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যেমন যত্ন নিয়ে করতে হবে একইভাবে রাজাকারদের তালিকাও যত্ন নিয়ে করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়ে যান তাহলে তার অন্তর্জ্বালা হবে না। কিন্তু রাজাকারের তালিকায় যদি মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে যায় সেটা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারে পরিণত করা অকল্পনীয় একটি বিষয়। ৪৮ বছর সময় নিয়েও সঠিক তালিকা তৈরি করা যায়নি। আমি মনে করি, ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত করা হয়েছে যাতে তালিকাটি বাতিল হয়, সে রকম চেষ্টা সরকারের ভেতরে অনেকেই করছে। রাজাকারের তালিকা বিতর্কিত করে এটাকে আবার প্রত্যাহার করা হলে সেটি হিমাগারে চলে যাবে। কোনোদিন সেটা প্রস্তুত হবে না। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের ভেতরে কেউ ঘাপটি মেরে আছে যারা এই কাজটি করছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী কি আগে থেকেই জানতেন এটা নিয়ে বিতর্ক হবে? তাই কি তিনি এখন প্রত্যাহারের কথা বলছেন। তারা জাতির সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার এই দায়টা কে নেবে। তার মানে পাকিস্তান যা বলছে আপনারাও তাই মেনে নিয়েছেন। আপনাদের কোনো রাষ্ট্র নেই। এটা কি পাকিস্তান রাষ্ট্র। এটা তো স্বাধীন বাংলাদেশ। সরকারের উচিত তদন্ত করে বের করা কারা এই কাজটি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, রাজাকারের তালিকা যদি সৎ উদ্দেশ্যে সঠিক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয় তাহলে সেটা খুবই ভালো কাজ। কিন্তু এটা যেভাবে করা হয়েছে সেখানে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রকাশের সময়টা আমার কাছে একটু রহস্যজনক মনে হয়েছে। যাচাইবাছাই না করে এত তড়িঘড়ি করে এটা প্রকাশ করা হলো কেন। দ্বিতীয়ত, এটা যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর ইস্যু তাই এটা ক্ষমতাসীন দল তাদের দলের বাইরে থেকে তৈরি করবে কি না এটা নিয়ে প্রচুর সন্দেহ থাকার কারণ রয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি দেশের অনেক কুখ্যাত রাজাকার যারা ক্ষমতাসীন সরকারে আছে বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়িত এমন কারো নাম দেখা যায়নি। আবার এমন অনেকের নাম এসেছে যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। এটা প্রমাণ করে ক্ষমতাসীনদের এই তালিকা করার মত সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা আছে কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে।

রাজাকারের তালিকা নিয়ে বরিশালে ঝড়
স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা নিয়ে বরিশালে ঝড় উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধারাই দাবি করেছেন এ তালিকা ভৌতিক। তালিকায় প্রতিষ্ঠিত, খেতাবপ্রাপ্ত এবং ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যেমন রয়েছেন তেমনি স্বামীকে রাজাকাররা হত্যা করেছে সেই বেদনা নিয়ে যে নারী আজও চোখের জল ফেলছে, তার নামও এসেছে রাজাকার হিসেবে। তালিকায় এসেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম আব্দুর রহমান বিশ্বাস, বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলমের বাবা, বরগুনার এমপি রিমনের বাবা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মিহির লাল দত্ত, ৩০ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মুক্ত সংগ্রামের সভাপতি মজিবুল হক নয়া ভাই’র নামসহ একাধিক নাম। সবচেয়ে বিস্ময় জাগানো ঘটনা হলো ’৭১-এর যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন হিন্দুরা। দেশ ছাড়েন কয়েক লাখ হিন্দু। বরিশালে রাজাকারের যে ৩৬ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ২৬ জনই হিন্দু। তালিকায় মোট ৬ জন নারী রাজাকার রয়েছেন, তার মধ্যে ৫ জনই হিন্দু। এ তালিকা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তালিকায় রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম আব্দুর রহমান বিশ্বাসের নাম। রয়েছে বরিশাল-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মাহে আলমের বাবা সাইয়েদ উদ্দিন তালুকদার, বরগুনার সংসদ সদস্য হাচানুর রহমান রিমনের পিতা খলিলুর রহমানের নাম।

বরিশাল শহরের শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের বাড়ি থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তুলে নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চক্রবর্তীকে। তার সহযোদ্ধারা জানান, ’৭১-এর ১২ই আগস্ট সুধীর চক্রবর্তীকে হত্যা করে নগরীর চাঁদমারীতে ফেলে দেয়া হয়। আর শহীদ সুধীর চক্রবর্তীর ছেলে তপন চক্রবর্তীও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও বরাদ্দ রয়েছে তাদের নামে। অথচ রাজাকারের তালিকায় তপন চক্রবর্তী তার মা, শহীদ সুধীর চক্রবর্তীর স্ত্রী ঊষা চক্রবর্তীরও নাম এসেছে।

এছাড়া নাম রয়েছে- বরিশালের সুকুমার চন্দ্র সাহা (সিরিয়াল-৯), বাকেরগঞ্জ এলাকার হরে কৃষ্ণ পাল (সিরিয়াল-১০), খয়রাবাদ এলাকার রাধাকান্ত দাশ (সিরিয়াল-১১), বাবুগঞ্জের অরুণ মিস্ত্রি (সিরিয়াল-২৪), বাবুগঞ্জের বিমল কৃষ্ণ পাল (সিরিয়াল-২৬), উজিরপুরের আভা রানী দাস (সিরিয়াল-২৭), উপেন্দ্র নাথ বসু (সিরিয়াল-২৮), পারুল বালা কর্মকার (সিরিয়াল-৩৩), মধুসূদন মিস্ত্রি (সিরিয়াল-৩৪), উজিরপুরের বিজয়া বালা দাস (৩৫), ঝাউতলা এলাকার কনক প্রভা মজুমদার (সিরিয়াল-৩৭), নাজির মহল্লা এলাকার রানা ঘোষ (সিরিয়াল-৩৮), ঊষা রানী চক্রবর্তী (সিরিয়াল-৪৫), বরিশাল নগরীর কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের কালীপদ ব্যানার্জি (সিরিয়াল-৫৩), গোড়াচাঁদ দাস রোড এলাকার শিশির কুমার মুখার্জি (সিরিয়াল-৬১), শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের তপন কুমার চক্রবর্তী (সিরিয়াল-৬৩), গৌরনদী উপজেলার ডিএন মণ্ডল (সিরিয়াল-৬৫), কাটপট্টি রোডের অমৃত লাল ঘোষ (সিরিয়াল-৭৬), কোতোয়ালি থানা এলাকার নরেন্দ্র নাথ মজুমদার (সিরিয়াল-৮০), মল্লিক রোডের হরিপদ দে (সিরিয়াল-৮১), কাশিপুরের জগদীশ চন্দ্র মুখার্জি (সিরিয়াল-৮৩), ফকির বাড়ি রোডের দেবেন্দ্র বিজয় মুখার্জি (সিরিয়াল-৮৭), আগরপুর রোডের মিহির লাল দত্ত (সিরিয়াল-৯৪), কাটপট্টির জিতেন্দ্র নাথ দত্ত (সিরিয়াল-৯৫), ভাটিখানা এলাকার মন্টু চন্দ্র দাস (সিরিয়াল-৯৯) এবং কোতোয়ালি এলাকার পিয়ারি লাল গাইন (সিরিয়াল-১০২)।

বিজয় দিবসের সকালে নিজের নামসহ মায়ের নাম রাজাকারের তালিকায় দেখে ক্ষুব্ধ সাংবাদিক, আইনজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, অথচ সেখানে আমাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। এত বড় অপমান আমি আশা করিনি।’

তারই মেয়ে রাজনীতিবিদ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তারা। বরিশাল জেলা বাসদের সদস্য সচিব মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় একজনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিলো, সেই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আবার তাকে রাজাকারের তালিকায় নাম লেখালো। আমাদেরকে হেনস্তা করার জন্যই পারিবারিকভাবে এই আক্রমণ আমাদের ওপর করা হচ্ছে।’

রাজাকারের তালিকায় নাম এসেছে যুদ্ধাহত প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মিহির লাল দত্তের নামও। অথচ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সই করা চিকিৎসা সহায়তা পান এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়েছেন বলে জানান তার সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত বলেন, ‘ভাতা পাচ্ছেন আমার বাবা। মুক্তিযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আজ এত বছর পর বাবার নাম রাজাকারের তালিকায় এসেছে। এতে আমি ভীত এবং ক্ষুব্ধ।’

বরিশালের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মহিউদ্দিন মানিক, বীরপ্রতীক জানান, ‘যেভাবে আসুক এ লিস্টে নাম এটা খতিয়ে দেখা উচিত। উদ্দেশ্যমূলকভাবে হতে পারে বা অন্যকোনোভাবে হতে পারে। কাজেই সরকারের এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেয়া উচিত।’

বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, ‘এগুলো কীভাবে হলো, সেটা আমরা যাচাই বাছাই করে তালিকা সংশোধন করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠাবো।’
রাজাকারের তালিকায় আগুন

এদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাসদ বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তীর বাবা মুক্তিযোদ্ধা এড. তপন কুমার চক্রবতী এবং দাদি শহীদ জায়া ঊষা রানী চক্রবর্তীকে রাজাকার তালিকাভুক্ত করার প্রতিবাদে এবং ভুয়া তালিকা বাতিল সহ তালিকা প্রণয়নে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে নগরীতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের নেতাকর্মীসহ বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এ বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় রাজাকারের তালিকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাকে গভীর ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোডে এ প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন- আজ আওয়ামী লীগ সরকার ৪৮ বছর পর বিজয় দিবসে একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রাজাকারের তালিকায় নাম প্রকাশ করে ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।

রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম বরগুনায় বিক্ষোভ
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মো. মজিবুল হকের নাম রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায়। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকায় নিন্দা জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্টদের পরিবার, স্বজনরা ও সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় বইছে।

পাথরঘাটা উপজেলায় সরকারি কেএম মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পাথরঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকার কারণে পাথরঘাটা রাজাকারমুক্ত হয়েছিল। আজ সেই ইতিহাস উল্টে গেছে। মজিবুল হকের নাম রাজাকারের তালিকায় প্রকাশ পাওয়ায় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। এ সময় উপস্থিত শত শত মুক্তিযোদ্ধা করতালি দিয়ে তার বক্তব্যের সমর্থন জানায়। এ ঘটনায় ১৭ই ডিসেম্বর পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ সভা করে।

পারিবারিক সূত্র ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানায়, প্রয়াত মো. মজিবুল হক, বাবার নাম মৃত আবদুল আজিজ। যাকে ভালোবেসে নয়া ভাই বলে ডাকতেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদ পাথরঘাটা শাখার সভাপতি, পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাথরঘাটা-বামনা সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন মো. মজিবুল হক ওরফে নয়া ভাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকেছেন মজিবুল হক। মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠন থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পাথরঘাটা সংগঠনের সভাপতি ছিলেন নয়া ভাই। পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের টানা ৪০ বছর সভাপতি ছিলেন তিনি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাথরঘাটার প্রত্যন্ত গ্রামে নয়া ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আশ্রয় নিয়েছেন মুক্তিকামী মানুষ। স্বাধীনতার স্বপক্ষের সংগঠক ও মুক্তিকামী মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী মজিবুল হক নয়া ভাইয়ের নাম সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় আসায় ক্ষুব্ধ তার পরিবারের সদস্যরাও।

এ বিষয়ে প্রয়াত মজিবুল হকের স্ত্রী নূরহাজান বেগম (৮৭) বলেন, আমার স্বামী ২০০৭ সালের ৩১শে ডিসেম্বর মারা যান। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনা করেছেন। যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী মানুষদের ভরণ-পোষণ দিয়েছেন। সে কি করে রাজাকার হয়? মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনিই এখন রাজাকারের তালিকায়। বিদায়ের বেলায় দেখতে হলো আমার স্বামীর নাম রাজাকারের তালিকায়, তাও আবার ১ নম্বরে। এখন কবর থেকে তুলে আমার স্বামীর বিচার করতে হবে?

মজিবুল হকের ছেলে রেজাউল হক বলেন, আমার বাবা পাথরঘাটায় মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাকে ঘিরেই এখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ তালিকায় স্থানীয় গেজেটভুক্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মজিবুল হক। আমির হামজা ওরফে রুস্তম খাঁ ও খলিলুর রহমান ওরফে মানিক গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মৃত্যুর পর দুই পরিবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছে। কিন্তু তাদের নাম এসেছে তালিকায়। এ ছাড়া আমজাদ আলী নামের একজনের নাম এসেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন।

পাথরঘাটার মুক্তিযোদ্ধা মনি মণ্ডল বলেন, বরগুনা মহকুমার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত মো. খলিলুর রহমানের নাম এই তালিকায় নেই। তবে রাজাকারের তালিকায় এক নম্বরে নাম আছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মজিবুল হকের নাম। তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা খলিল ও আমির হামজার নাম আছে রাজাকারের তালিকায়, যা লজ্জার বিষয়।

পাথরঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি আব্দুল মন্নান হাওলাদার জানান, মজিবুল হক তার জীবন যৌবন সব আওয়ামী লীগকে দান করে গেছেন। তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই মঞ্চে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু যাকে আওয়ামী লীগ বলে চিনতেন তিনিই মজিবুল হক।

বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মোতালেব মৃধা বলেন, মারা যাওয়ার এত বছর পর আবার ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন মজিবুল হক নয়া ভাই। তিনি কখনো রাজাকার ছিলেন না। এটা জানলে তার মৃত আত্মাও কষ্ট পেতো । তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ও বন্ধু। ছিলেন স্বাধীনতার সংগঠক। তার নাম কী করে রাজাকারের তালিকায় এসেছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। নয়তো আন্দোলনে নামবে মুক্তিযোদ্ধারা।

এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, বরগুনা জেলা প্রশাসন বিষয়টি জেনেছে। রাজাকারের তালিকাটি কেবল প্রকাশিত হয়েছে। মজিবুল হক রাজাকার ছিলেন না। রাজাকারের তালিকায় কীভাবে তার নাম এলো বিষয়টি তদন্ত করে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সূত্র: মানবজমিন।