মারজান চৌধুরী:
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে গত ছয় বছরে অন্তত ২০০ টির উপরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্য গত দুই বছরে এ সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। রোহিঙ্গা শিবিরে গুলোতে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গোলাগুলি প্রতিনিয়ত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সহিংসতার নেপথ্য কারণগুলো কী? কারা রয়েছে এর পেছনে?
উখিয়া থানা মিডিয়া সেলের তথ্য মতে ২৬ জুন রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ১৮ তে আনুমানিক ৬ টা ৩০ মিনিটে আশিক এলাহী (২৩) নামের এক রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পেলে রাখে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ’তারা এর আগে থেকেই মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দাদের কথা থেকে মনে হয় তারা যেন এধরণের সহিংসতাকে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছেন। উখিয়া থানা মিডিয়া সেলের তথ্য মতে জানা যায়, জুন মাসের ১৯ তারিখে রোহিঙ্গা শিবির-১০ মোহাম্মদ সিরাজের ছেলে ইমান হোসেন (১৫)কে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা আরেক গুলি বদ্ধ হয়ে আহত হন একিই রোহিঙ্গা শিবিরে আজিজুর রহমানের ছেলে মো: নুর। জুন মাসের ১৭ তারিখে রোহিঙ্গা শিবির-২ মৃত আব্দুল শুক্কুরের ছেলে নুর হোসেন প্রকাশ ভুট্টাে (৪০) কে মাতায় গুলি ও পিটে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মিডিয়া সেলের তথ্য মতে আরো জানা যায়, ১৩ জুন রোহিঙ্গা শিবির-১০ ফজু মিয়ার ছেলে বশির উল্লার (৩৫) কে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে মনোরা বেগমের ছেলে রুমনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল একটা সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকজন। পাঁচদিন আটকে রাখার পর তাদের কথা মতো একটি নির্দিষ্ট স্থানে এক লাখ ২০ হাজার টাকার রেখে আসলে ছেলে বাড়িতে আসে। তিনি বলেন, ক্যাম্পের লোকজনের কাছে চেয়ে চিন্তে, ধার করে, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে তিনি টাকার জোগাড় করেন। তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, এই কথা পুলিশ বা সাংবাদিকদের জানালে আবার এসে হামলা করে মেরে রেখে যাবে। তাই তিনিও মামলা করতে বা কারও কাছে অভিযোগ জানাতে যাননি। মনোরা বেগম বলছিলেন, ‘’আমাদের ক্যাম্পের মধ্যেই থাকতে হবে। তাইলে ওদের সাথে ঝামেলা করে লাভ কি? সব জায়গায় ওদের লোক আছে। উল্টো আমার জীবন যাবে। তারচেয়ে ওদের সাথে তালমিল করে থাকাই ভালো।‘’ উভয় ঘটনার জন্য রোহিঙ্গা শিবিরে ভিত্তিক কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তারা অভিযোগ করেছেন। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় যে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, সেটা যেন ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোন কথা বলতে চান না। কারণ তাদের ভয়, কেউ ‘ফোকাস’ হয়ে গেলেই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কারণ যারাই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছে, এমনকি প্রশাসন-গোয়েন্দাকে তথ্য দিয়েছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তারাই পরবর্তীতে এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ মূল কারণ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় একের পর এক সহিংস ভাবেই যেসব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে, তার কারণ জানতে প্রতিবেদকের সথে কথা হয়েছে কক্সবাজারের পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গা, প্রশাসনের সদস্য, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সচেতন মহলের সাথে। তারা সবাই একবাক্যে বলছেন, শিবিরে সহিংসতার মূল কারণ হিসাবে রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের এবং মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় নিরাপত্তার কাজ তদারকি করে পুলিশের যে আর্মড ব্যাটেলিয়ন, তার একটি, আর্মড ব্যাটেলিয়ন আটের কমান্ডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘’ক্যাম্পের ভেতর অনেকগুলো গ্রুপ রয়েছে। তারা একে অন্যকে হটিয়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে, নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। কারণ শিবির নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকবে, মাদক ব্যবসা, পাচার, অপহরণ সব কিছু তারা করতে পারবে। এই কারণেই এখন যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করেই এগুলো বেশি ঘটছে।‘’ এই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। রোহিঙ্গা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এর বাইরে নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ, ডাকাত সালেহ গ্রুপ, ইসলামিক মাহাস গ্রুপ রয়েছে। আরসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত। আরএসও আগে থেকেই কুতুপালং শিবিরের সক্রিয় ছিল। ২০১৭ সালের পর থেকেই আরসা এবং অন্য সংগঠনগুলো আরও বেশি সক্রিয় আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের সূত্রগুলো বলছে, এসব গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এসব নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। আরসা এবং আরএসও আলাদাভাবে কাজ করলেও তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই দুটি সংগঠন পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে আরসার বিরুদ্ধে আরএসও গত দুই বছরে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কর্মহীন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই রোহিঙ্গাদের ঘিরে মাদক, পাচার, অপহরণসহ নানারকম অপরাধের সাম্রাজ্য তৈরি করেছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। মাদক পাচার, অপহরণ নিয়ে কোন দ্বন্দ্বের তৈরি হলেই তারা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা বিভিন্ন শিবিরে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে রেখেছে। যখন তারা সেই প্রভাব আরও বিস্তারের চেষ্টা করে, তখন আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি বা হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গা মাঝিরা বলছেন, ‘’শিবিরের সব জায়গায় এসব দলের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শিবিরে কাজের সুযোগ সীমিত হওয়ায় টাকা পয়সা আর শক্তির দেখানোর লোভে অনেক রোহিঙ্গা তরুণ এসব গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।‘’ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য কৌশল করে এসব সন্ত্রাসী দল। তারা দল বেধে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে শিবিরে ভেতরে চলাফেরা করে। গত মাস খানিক আগে ১৮ রোহিঙ্গা শিবিরে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গেলে দিন দুপুরে ইসলামি মাহাসের ১৮ শিবিরের কমান্ডার নমিউদ্দিনের নেতৃত্বে ১০/১২ জন সন্ত্রাসী প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে আব্বাস নামের এক রোহিঙ্গা কে অস্ত্রে মূখে ধরে নিয়ে য়ায় তাদের আস্থানায় পরে তাদের চাহিদা মত টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা বলেন এই রকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে। কাউকে টার্গেট করা হলে সুবিধা মতো সময়ে এসে তারা হত্যা করে। কোন সশস্ত্র গ্রুপ একটি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আরেকটি গ্রুপ এসে পাল্টা হামলা করে সেই এলাকার দখল নেয়ার চেষ্টা করে। ফলে আরসা সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলা করছে ইসলামি মাহাস, আবার ইসলামি মাহাস সদস্যদের ওপর পাল্টা হামলা চালাচ্ছে আরসা। এসব কারণে গত দুই বছরে ১০০টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের একজন বাসিন্দা প্রতিবেদেককে বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এর বেশ কয়েকবার শিবিরে আগুন দেয়া হয়েছে। এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আরেক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর্মড ব্যাটেলিয়ন ১৪ কমান্ডার প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘’রোহিঙ্গা শিবিরে সাম্প্রতিক যেসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, প্রায় তার সবই আরসা আর ‘ইসলামি মাহাস’ সশস্ত্র দুটি গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ঘটেছে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরে সার্বিক পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।‘’ আগে আরসার লোকজন নাইক্ষংছড়ির শূন্য রেখায় রোহিঙ্গা শিবিরে শক্ত ঘাটি তৈরি করেছিল। শূন্য রেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দেয়ার পর তারা অন্য শিবিরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থের মূল উৎস মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচারের ব্যবসা। মিয়ানমারের ইয়াবা তৈরিকারীদের সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা, নদী থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরে এই চক্রের কাছ থেকে সেটা বাংলাদেশি মাদক কারবারিদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে যেসব পণ্য পাচার হয়ে দেশে আসে, সেটাও নিয়ন্ত্রণ করে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্যাম্প থেকে মানব পাচার, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করার মতো অপরাধ। যে এলাকা যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেই এলাকার দোকান থেকে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও এরা চাঁদা নেয়। কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাবে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তিন হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মানব পাচার ও পুলিশের ওপর হামলার মতো অভিযোগ রয়েছে। শিবিরে শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাম্রাজ্য শিবিরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবী করলেও শিবিরগুলো ঘুরে সেটি মনে হয়নি। তবে সচেতন মহল ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবী রোহিঙ্গা শিবির নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রয়োজন। কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে গাদাগাদি করে ১৫ লাখের বেশি মানুষ বাস করে। এক ঘরের সাথেই আরেক ঘর লাগানো, তার ফাঁকে ফাঁকে সরু রাস্তা। একবার ঢুকে গেলে নতুন কারও জন্য পথ চিনে ফেরা মুশকিল।
শিবিরের ভেতরে খুব বড় সড়ক নেই, পথঘাটগুলো এমন সরু যে, কোথাও কোথাও পাশাপাশি দুইজন যাওয়া যায় না। পাহাড়ি টিলাগুলোর গায়ে গায়ে ঘরবাড়ি আর পায়ে চলা পথ উঠে গেছে। গাড়ি নিয়ে শিবিরের ভেতরে খুব বেশি দূর যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলে এসব শিবিরের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর চলাচল খুব বেশি নেই। কিন্তু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা ঠিকই রয়েছে। বিশেষ করে শিবিরগুলোর ভেতরের দিকে, পাহাড়ি এলাকায় এসব গোষ্ঠীর তৎপরতা বেশি। বিশেষ করে রাতের বেলায় এসব শিবিরে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও খুব বেশি সক্রিয় থাকে না। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড রাতের বেলাতেই চলে। কয়েক বছর আগেও বেশিরভাগ হামলার ঘটনা রাতের বেলায় করা হতো। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে দিনের বেলাতেও হত্যার ঘটনা ঘটছে। মুখোশ পড়ে হত্যা করায় এসব ঘটনায় মামলা হলে আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের। এক রোহিঙ্গা বলছেন, হঠাৎ করে এসে ওরা হামলা করেই চলে যায়। কেউ চিনলেও তাদের নাম বলতে চায় না। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার যদিও বলছেন, ‘’অন্যসব মামলার মতো রোহিঙ্গা শিবিরের ঘটনাতেও তারা আসামী গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়, বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হয়।‘’ কিন্তু ডাকাতি বা অপহরণ মামলা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের কোন মামলায় বিচার কাজ শেষ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। শিবিরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যাম্পের ভেতর হত্যা, অপহরণ বা সহিংসতার অনেক ঘটনায় মামলাই হয়না। রোহিঙ্গারা ভয়ে থানা পুলিশ বা আদালতের কাছে যেতে চায় না। আবার পুলিশও সহজে শিবিরের ভেতরে অভিযান চালাতে চায় না। একজন পুলিশের কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘’রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ওপর সারা বিশ্বের নজর থাকে। ফলে সেখানে একটা অভিযানে কিছু ঘটলে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়ে যেতে পারে। তাই এখানে অভিযানের ব্যাপারে আমরা একটু সতর্ক থাকতে চাই।‘’ পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ড, মাদক বা পারিবারিক নির্যাতনের কোন মামলায় যদি আসামি গ্রেপ্তারও করা হয়, পরে আর সাক্ষীর অভাবে বিচার এগোয় না। কিছুদিন পরেই তারা জামিন বা খালাস হয়ে বেরিয়ে আসে। মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর কড়াকড়ি প্রশাসনের রোহিঙ্গাদের একজন শীর্ষ নেতা মহিবুল্লাহকে ২০২১ সালের ৩০শে অক্টোবর কয়েকজন ব্যক্তি এসে গুলি করে হত্যা করে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস মিয়ানমারের নেতা মহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা অধিকার এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ওই হত্যাকাণ্ডের পরেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করে সরকার কর্তৃপক্ষ। শিবিরের ভেতরে পুলিশের নজরদারি চৌকি বাড়ানো হয়েছে। মাদক ও অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বেড়েছে। আর্মড ব্যাটেলিয়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে নজরদারি ও অভিযান বাড়িয়েছে র্যাব ও পুলিশও। এই বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবির কেন্দ্রিক চুরি, ডাকাতি, খুন, গুম অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কোনভাবেই করতে দেয়া হবে না। এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরের তথ্যের জন্য প্রশাসন নির্ভর করে শিবিরের মাঝি, ব্লক মাঝিদের ওপরে। তাদের ওপর নির্দেশ দেয়া আছে, সশস্ত্র কাউকে দেখলেই যেন প্রশাসনকে খবর দেয়া হয়। কিন্তু অনেকেই এসব কর্মকাণ্ড দেখলে বা জানলেও চুপ করে থাকে। কারণ তাদের আশঙ্কা, সেটা হলে পরবর্তীতে তাদেরকে হত্যার হামলা আসবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে দেয়া পুলিশের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫শে অগাস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ১৩২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা নেতা বা মাঝি। একজন ব্লক মাঝি বলছিলেন,, ‘’সরকার আমাদের শিবিরে দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে কারা শিবিরে আসে যায়, রাতে কারা ঘোরাফেরা করে, সেই তথ্য জানাতে বলে। ওরা মনে করতেছে, আমরা ওদের কাজকর্মে বাধা তৈরি করছি। ‘’ ‘’এই জন্য এখন মাঝিদের বেশি টার্গেট করা হচ্ছে। ওরা মনে করে, প্রশাসনকে সব খবর আমরাই দেই। এখন আমি খবর দেই আর না দেই, কোন ব্লকে বা শিবিরে যদি কোন বাহিনীর কেউ ধরা পড়ে, কেউ মারা যায়, ওরা মনে করে, মাঝিরাই খবর দিয়েছে।‘’ গত এক বছরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় অন্তত ১৪ জন মাঝি বা সাব-মাঝি নিহত হয়েছে এরকম হামলায়। ফলে রোহিঙ্গাদের ভেতরকার অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য পেতেও বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই নানা ধরনের ছোটবড় অপরাধের সাথে জড়িত থাকায়, নিয়ম ভঙ্গ করে শিবিরের বাইরে গিয়ে কাজ করায় তারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহজে যেতে চায় না। শিবিরের ভেতরের অপরাধ দমন কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি একজন রোহিঙ্গা মাঝির সঙ্গে থাইংখালী রোহিঙ্গা বাজারের একটি নিভৃত স্থানে বসে যখন আমার কথা হচ্ছিল, তিনি একটু পরপরেই আশেপাশে তাকাচ্ছিলেন যে, কেউ কথাগুলো শুনে ফেলছে কিনা। রোহিঙ্গা শিবিরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা বলছিলেন, আরসা বা অন্য সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান থাকলেও আরএসও ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা দেখা যায়। কারণ এদের দিয়ে আরসাকে দমন করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এই বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের আগে পর্যন্ত মাদক, সন্ত্রাস, অপহরণের অভিযোগ রয়েছে, এমন অনেক রোহিঙ্গা পুলিশ ও র্যাবের সাথে ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হয়েছেন। ২০১৮ সালের মে মাসে সারা দেশে যে মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে, তাতে কক্সবাজারেই নিহত হয়েছিল ২৯৯ জন, যাদের মধ্যে ৭৯জন ছিল রোহিঙ্গা। সহিংসতার প্রভাব আশেপাশের এলাকায় রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ছে আশেপাশের এলাকাগুলোতেও। রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর এসব অপরাধের শিকার হচ্ছে টেকনাফ ও উখিয়ার অনেক সাধারণ মানুষও। উখিয়ার সাংবাদিক বলছিলেন, এই এলাকায় বনে কাঠ কাটতে যাওয়া মানুষজনকে অপহরণ অনেক বেড়ে গেছে। পরে হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেই কাঠুরিয়াদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। ভয়ে তারা মামলা করতেও যাননি। অর্থের লোভে অপহরণ, মানব পাচার এবং মাদক পাচারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাথে সাথে জড়িয়ে পড়ছে স্থানীয় কিছু মানুষ। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে মাদক আনার পরে প্রথমে রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে মজুদ করা হয়। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সেটা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় বলে গোয়েন্দা একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার বলেন, ‘’যখন কয়েক লাখ মানুষ অধ্যুষিত একটা এলাকায় একের পর এক অপরাধের ঘটনা ঘটতে থাকে,তখন আশেপাশের এলাকাতেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। ২০১৭ সালের পর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আশেপাশের এলাকায় মামলা, অপহরণের ঘটনা, মাদকের মামলা অনেক বেড়েছে। অনেক সময় শিবিরে উত্তেজনার প্রভাব এসব এলাকাতেও পড়ে। তবে আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করি”। ফেরত যেতে চায় না রোহিঙ্গাদের কিছু গ্রুপ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর একাধিক মাঝি এবং সাধারণ বাসিন্দারা বলেছেন, আরসার মতো কিছু গ্রুপ রয়েছে, যারা প্রত্যাবাসন চায় না। ফলে যারাই প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলেছেন বা বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এই গ্রুপগুলো দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে মাদক এবং নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গড়ে তুলেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলে তাদের সেই প্রভাব আর থাকবে না, এই আশঙ্কায় প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে কয়েকটি গ্রুপ। এমনকি প্রত্যাবাসনের আলোচনা শুরু হওয়ার পর সেটা ঠেকাতে রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকবার নাশকতামূলক আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় মোট ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি আগুন নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা বলছেন, কেউ যদি প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলে, লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করে, তারাই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলার শিকার হয়। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে এই কারণে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা মনে করেন। যেসব মাঝি বা সাব-মাঝি প্রত্যাবাসনের পক্ষে, এরকম কয়েকজন মাঝি বা সাব-মাঝির ওপরেও হামলা হয়েছে। একজন মাঝি বলছিলেন, ‘’কেউ যদি রোহিঙ্গা ফেরতের পক্ষেও থাকে, সেটা কেউ বলতে চায় না। মিডিয়ায় কারও নাম বা ছবি ছাপা হলেও পরদিন এসে গুলি করে হত্যা করবে’’।