অযাচিত বাহুল্যতা বর্জন করে, ন্যায্য ও বাস্তবসম্মত রাজস্ব নির্ধারনের মাধ্যমেই সমাজে বিদ্যমান অসঙ্গতিসমুহ দূরীকরণ সম্ভব।

Date:

 

।। এম আর আয়াজ রবি।।

রাজস্ব আদায় করা একটি সরকারের সবচেয়ে প্রাথমিক কাজগুলির একটি। কেননা রাজস্ব ছাড়া সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সরকারি আইন বলবৎকরণ সম্ভব নয়। রাজস্বের এই চাহিদাই আধুনিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকাশের একটি প্রধান উপাদান ছিল। রাজস্ব সরকারের ঋণ ও অর্থ সৃষ্টি থেকে পৃথক একটি ধারণা।

রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার মুল চালিকাশক্তি রাজস্ব, তাই রাজস্ব আদায় করা সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কাজ। রাজস্ব আদায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্র রয়েছে। তারমধ্যে সরকারি খাস জায়গা, খাস জায়গায় অবস্থিত খাল-নদী, পার্কিং, দিঘি, পুকুর এবং সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ের হাট-বাজার ইজারা প্রদান করে সরকারের কোষাগার বৃদ্ধি করার অবলম্বন হচ্ছে ইজারার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা।

আমার জানা মতে, কক্সবাজার জেলায় বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৩৮ টি বালুমহল ইজারা প্রদান করা হয়েছে। তন্মধ্যে বালুখালী-১ মহল, উখিয়া ঘাট খতিয়ান-১, দোছড়ি ওয়ালাপালং ও রাজাপালং মহল, খতিয়ান-১, থাইংখালী মহল, পালংখালী খতিয়ান-১, পালংখালী মহল, খতিয়ান-১, হিজলিয়া মহল, রাজাপালং খতিয়ান-১, ধোয়াংগারচর মহল, রাজাপালং খতিয়ান-১, কুমারিয়ারচরা রাজাপালং খতিয়ান-১ সহ মোট ৭টি বালু মহল ইজারা প্রদান করা হয়েছে। সর্বমোট ইজারার মুল্যমান ১ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু উল্লেখিত ইজারাকৃত বালুমহলে সারা বছর ব্যাপি বালি উত্তোলন করার মত তেমন কোন বালি থাকেনা। বর্ষা মৌসুমে কিছু বালি উত্তোলনের উপযোগি থাকলেও অন্য সময়ে বালি উত্তোলনের কোন সুযোগ থাকার কথা নয়। তাই ইজারাকৃত নির্ধারিত স্থানে সঠিক ও বৈধভাবে বালি উত্তোলন করলে ৭টি বালু মহালে সর্ব সাকুল্যে বালি উত্তোলন করতে পারবে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার। কিন্তু উক্ত ৭ বালু মহালের ইজারাকৃত মুল্য প্রায় কোটির উপরে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ইজারাগ্রহণকারীরা জেনেশুনে ক্ষতির সম্মুখীন হতেই কি এই ইজারা বা লীজ নিয়েছে? ব্যাপারটি আসলেই সেরুপ বা সেরকম নয়। ইজারাগ্রহীতারা একটা অঞ্চলের শুধু আইনী অনুমতি গ্রহণ করেছে, কিন্তু তাদের আয়ত্বে চলে গেছে ইজারা গ্রহণের নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে শত শত একর সরকারি পাহাড়, টিলা, বনভুমি। একটি নির্দিষ্ট এলাকার বালি মহালকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে তারা আশে পাশের শত শত একর জায়গা করায়ত্ত্ব করে কোটি কোটি টাকার বালি, মাটি বিক্রি করছে প্রকাশ্যে দিবালোকে। এ ব্যাপারে প্রশাসন, বনবিভাগ সব জানেন কিন্তু কিছুই জানেন না!অনেকক্ষেত্রে এসব বালিমহল শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের হাতে জিম্মি থাকে। তাদের হাত অনেকদূর। তারা সরকারের উপরে সরকার!

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন-১৯৯৫ (২০০০ সালে সংশোধিত) এর ১ নং ধারার ৬(খ) উপধারায়, পাহাড় কাটা সম্পর্কে বাধানিষেধ অপশনে বলাহয়েছে-“ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান কর্তৃক সরকারী বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্ত্ব শাসিত প্রতিষ্টানের মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন, বা মোচন ( ) করা যাইবেনা। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদফতরের ছাড় পত্র গ্রহণক্রমে কোন পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইত পারে“। উক্ত আইনে প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষতির ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যাপারে ১ নং ধারায় ৭(১) উপধারায় বলাহয়েছে, “ মহাপরিচালকের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, কোন ব্যক্তির কাজ করা না করা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবেশ ব্যবস্থা বা কোন ব্যক্তি বা গোষ্টির ক্ষতিসাধন করিতেছে বা করিয়াছে, তাহা হইলে তিনি উক্ত ক্ষতির পরিমান নির্ধারন পুর্বক উহা পরিশোধ এবং যথাযথ ক্ষেত্রে সংশোধনমুলক ব্যবস্থা গ্রহন বা উভয় প্রকার ব্যবস্থা গ্রহনে জন্য নির্দেশ দিতে পারিবেন এবং উক্ত ব্যক্তি উক্ত নির্দেশনা পালনে বাধ্য থাকিবেন”।

কিন্তু দেশে আইন আছে, আইনের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানাবিধ শীতলতা। উল্লেখিত এসব বালু মহালগুলো প্রতিযোগিতার নামে নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত টেন্ডার করে ইজারা দিয়ে সরকারি রাজস্ব আদায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে। এটি সরকারি রাজস্ব বাড়ানোর হাতিয়ার নাকি নিরবচ্ছিন্ন পাহাড় কেটে উজাড় করে পরিবেশ উজাড় করে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের মাধ্যমে মনুষ্যকুল ও জীব-জন্তু,পশু-পাখির অভয়রন্য ধ্বংস করে দীর্ঘ মেয়াদি দেশ ও জাতির ক্ষতির কারণ-তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। যতদিন পর্যন্ত সরকারি রাজস্বের নামে অযাচিত রাজস্ব আদায় বন্ধ হবেনা, যতদিন যুক্তিসংগত ইজারার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আদায় হবে না, ততদিন পাহাড় কাটার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পেরেকগুলো কেটে সাবাড় হতে থাকবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে হাট বাজার ইজারার নামেও চলছে একই কায়দায় অরাজকতা ও লুঠতরাজ। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার উখিয়া বাজার, কুতুপালং বাজার, কোট বাজার, মরিচ্যা বাজার, বালুখালী বাজার, থাইংখালী ও পালংখালী বাজারসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশে পাশে আরও কতক বাজার গড়ে উঠেছে। প্রায় সবগুলো বাজারে ইজারার নামে ১০ টাকার বাজার ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকছে। ফলে বর্ধিত অংশ প্রান্তিক ভোক্তা, উৎপাদনকারী, প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে জোর পুর্বক আদায় করতে গিয়ে মাছ-মাংস, তরিতরকারি, শাকসব্জিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মুল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। অধিকন্তু শীতের শাকসব্জির ভরা মৌসুমেও পন্যের মুল্য মানুষের ক্ষয়ক্ষমতার বাইরে। দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।

মনে করেন, যেসব খাল/নদীর ইজারা দেওয়া হয়, সেখানে যেকোন একটি বালু মহালে সারা বছর বালি উত্তোলন করে ১ লাখ বা ২ লাখ টাকার বালি পাওয়া না গেলেও, তার ডাক/ইজারা হয় ১০-২০ লাখ টাকা, অনেকক্ষেত্রে আরো বেশি! ইজারা গ্রহীতা নিশ্চয়ই তার টাকা ইনভেস্ট করে, কিছু লাভের আশা করবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের প্রতিযোগিতায় সে বৈধভাবে তার লব্ধ ইজারাপ্রাপ্ত স্থান থেকে লাভের কথা দূরে থাক, সরকারি কোষাগারে প্রদানকৃত রাজস্বের সমপরিমান টাকা আদায় করা তার পক্ষে শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব হয়ে উঠে। তাই সে বাধ্য হয়ে ইজারা প্রাপ্তির কাগজ দস্তাবেজকে সম্বল করে ইজারাকৃত স্থানের বাইরে গিয়ে, সংরক্ষিত বন, পাহাড়কে টার্গেট করে।

এসব অবৈধ রাষ্ট্রদ্রোহী সিন্ডিকেটচক্র রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন করে অবৈধভাবে পাহাড় থেকে বালি, মাটি উত্তোলন করে। আইনে যেখানে, ইজারাপ্রাপ্ত স্থানের বাইরে গিয়ে বালি/ মাটি উত্তোলনের সুযোগ নেই, বালি/মাটি উত্তোলনে কোন মেশিন ব্যবহারও নিষিদ্ধ। দিনের বেলায় বালি উত্তোলন ও উত্তোলিত স্থানে মজুদ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেখানে রাতের অন্ধকারে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে শত শত পাহাড় কেটে উজাড় করা হয়েছে। উখিয়া-টেকনাফ, পার্বত্য এলাকায় চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। এসব অপকর্মের সাথে জড়িত রয়েছে চিহ্নিত সিন্ডিকেটচক্র। তাদের অনেকেই আবার ইয়াবা কারবারের সাথেও জড়িত বলে সুত্রে উঠে এসেছে। আবার তাদেরকে ইন্ধন যোগাচ্ছে একদল প্রভাবশালী তথাকথিত শিক্ষিত মহল এবং জনপ্রতিনিধি। তারা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে যাচ্ছে। এসব অপকর্মের মাধ্যমে, এই মহল নিজের যেমন ক্ষতি করছে, আশে পাশের পরিবেশ, প্রতিবেশ নষ্ট করছে, জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস করছে, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। আগামী প্রজন্মের সুন্দর বাসস্থান ধ্বংস করছে। এসব অপকর্মের সাথে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সেই তথাকথিত সিন্ডিকেট চক্র একাকার। এখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন যেমন জড়িত, ক্ষমতার বাইরে যারা তারাও জড়িত। দেশ ও জাতির ক্ষতি করার জন্য সব অপকর্মকারীরা ঐক্যবদ্ধ। আবার প্রশাসনের উচ্চমহলের কর্তা ব্যক্তিরাও কোন অজানা কারণে সেই সিন্ডিকেট চক্রের পক্ষ অবলম্বন করে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন অসমর্থিত সুত্রে পাওয়া যাচ্ছে। অসমর্থিত সুত্রে আরো জানা যাচ্ছে মাসিক মাসোহারার প্যাকেট আদান প্রদানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। পথে ঘাটে যে নামমাত্র অভিযান পরিচালিত হচ্ছে তা শুধুমাত্র লোক দেখানো ‘আই ওয়াশ’! আবার সংবাদ মাধ্যম, গণ মাধ্যমকে বা গণমাধ্যম সংগঠনগুলোকে মাসিক মাসোহারা প্রদানের মাধ্যমে মুখ বন্ধ রেখে অপকর্ম চালিয়ে যাবার ব্যাপারে অনেকে বক্তব্য প্রদান করেছেন। এভাবে চলতে দেওয়া যায়না। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসন, সুশীল সমাজসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের আরো বেশি অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে হবে।
লেখকঃ কলামিষ্ট ও সভাপতি-বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) উখিয়া উপজেলা শাখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার হলেন এম. দলিলুর রহমান

  (বিশেষ প্রতিনিধি) বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের লোহাগাড়া উপজেলা প্রতিনিধি...

মাদক কারবারে পাচারকারী আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে গডফাদার

মায়ানমার থেকে অবৈধভাবে প্রবেশ করা সিগারেট, স্বর্ণের বার, ইয়াবাসহ...

নরসিংদীতে বজ্রাঘাতে মা-ছেলেসহ ৪ জন নি’হ’ত

নরসিংদী প্রতিনিধি: নরসিংদীতে জমিতে ধান কাটার কাজ করার সময় বজ্রাঘাতে...

সংবাদ প্রকাশের জের:পাচার কালে জ্বালানী তেল জব্দ:টহলদলের গাড়ীতে হামলা:অধরা চোরাকারবারি

  এম.এ.রহমান সীমান্ত: গত কয়েকদিন ধরে দৈনিক গণসংযোগ পত্রিকায় ববস্তুনিষ্ঠ ও...