জাতীয় নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের নির্বাচনে ব্যবহারের শংকা, প্রতিরোধে প্রস্তুত প্রশাসন 

Date:

 

[এম আর আয়াজ রবি ]

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার ও সরকার সুষ্ঠু, গ্রহনযোগ্য ও ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধ পরিকর।

ভোটের মাঠে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও আরো নিবন্ধিত ১৭য়ি দলসহ প্রায় ৬০টি দল তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া ও অজুহাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় সাব্দিক অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অংশগ্রহণ মুলক নির্বাচন হচ্ছে না বলে দেশের মানুষ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পক্ষের প্রচার প্রচারণা রয়েছে।

কক্সবাজার-০৪ উখিয়া টেকনাফ আসনেও দেশের অন্যান্য আসনের মতো প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলের অংশ গ্রহন না থাকলেও অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্রসহ ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা ও একই দলের স্বতন্ত্র ঈগলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

সীমান্তবর্তী আসন, উখিয়া টেকনাফ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। এখানে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গাদের বসবাস।

ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি কল্পে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ বা ব্যবহার করার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের মিছিল-মিটিং কিংবা স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে প্রলোভনে ফেলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে। তবে এরিই মধ্যে সব প্রার্থীকে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করার আহ্বান যেমন জানানো হয়েছে তেমনি রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের কড়া হুসিয়ারী জানিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএনসহ বিভিন্ন গোয়েন্দাও সংস্থার লোক।

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ার, বালুখালী ও থাইংখালী এলাকাগুলো মহাসড়কের পাশে। সড়কের পাশেই রয়েছে রোহিঙ্গাদের শত শত বসতি। বসতির চতুর্পাশ্বে রয়েছে কাঁটা তারের ঘেরা। আর রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যেতে না পারে সে জন্য দেয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়ার সাথে এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্ট। কিন্তু সেই কাঁটাতারের বেড়া কেটে করা হয়েছে ফাঁকফোকর। কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের মধ্যে রয়েছে প্রায় ২৯ টি কাটা হোল। অন্যান্য ক্যাম্পেও রয়েছে সেরকম বিভিন্ন ফাঁক ফোকর যা দিয়ে প্রতিদিন অবাধে ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে শ্রমিকের কাজ,, টমটম, সিএনজি চালনাসহ বিভিন্ন পেশায় সকালে গিয়েভবিকালে ফিরে আসছে।

কাঁটাতারের ঘেরার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথা হচ্ছে , কাঁটাতারের ফাঁকফোকর বা চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প ছাড়ছেন তারা। লক্ষ্য, যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যক্তি ও পরিবার ভেদে যেসব ভরণপোষণ দেওয়া হয় তা নিতান্ত তাদের প্রয়োজন মেটেনা বলেই তারা ক্যাম্পের কাঁটাতারের বাইরে আসে।

শ্রমকাজে নিয়োজিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতে,
‘ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়েছি পেটের দায়ে। ক্যাম্প যা দিচ্ছে তা দিয়ে সংসার চলছে না। তাই ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যে কাজ পাচ্ছি তা করে টাকা উপার্জন করছি। আমরা কোথাও নিরাপত্তা পাচ্ছি না; না ক্যাম্পে না নিজ দেশে। আমরা মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার অধিকার চাই।’

অন্যদিকে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের অভিযোগ অনেক পুরানো। ভোটের মিছিল-মিটিং, প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার লাগানোসহ নানা কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়। তাই এবারও বেড়েছে সেই শঙ্কা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের দাবি, নির্বাচনে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে। রোহিঙ্গারা বিশেষ বিশেষ দলের হয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

কুতুপালং ক্যাম্পসংলগ্ন রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচনী কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের অন্তুভুক্তি ইতিমধ্যে চোখে পড়েনি। নির্বাচনের আরো তিন চারদিন বাকি।কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এই কাজে না জড়ানোর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা ও প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের হস্তক্ষেপও জরুরি।’

এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৪ নং রাজা পালং ইউপি’র চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উখিয়া উপজেলা সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘ নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে প্রশাসনের কড়া হুসিয়ারী রয়েছে। ইতিমধ্যে কোন প্রকার রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়েনি। রিটার্ণিং অফিসার, সহকারী রিটার্ণিং অফিসার, যেলা পুলিশসহ এপিবিএন পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করা হয়েছে। তাই নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতার তেমন সুযোগ নেই”।

কক্সবাজার-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. নুরুল বশর বলেন, ‘মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশলে অনেক রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে স্বার্থান্বেষী মহল। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী’সংস্থাওসহ প্রশাসনকে জিরো টলারেন্স নীতি পালন করতে হবে। আমি আজকেও রিটার্ণিং অফিসার মহোদয়কে এটিসহ আরো অনেক ব্যাপারে অভিযোগ দিয়েছি প সুরাহা করার প্রতিশ্রুতি পেয়েছি।”

র‌্যাব ১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা এ আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারি না। যে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গাদেরকে নির্বাচনকেন্দ্রিক যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারে। ফলে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর প্রবেশদ্বারে রয়েছে এপিবিএনের চেকপোস্ট। কিন্তু এসব চেকপোস্টেও দেখা যায় ঢিলেঢালা ভাব। তবে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করতে সব প্রার্থীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। আর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। এই রোহিঙ্গারা যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে না পারে এই জন্য কক্সবাজারের সব প্রার্থীর কাছে সহযোগিতা চাই।’

উখিয়া ৮ এপিবিএনের সহঅধিনায়ক (পুলিশ সুপার) খন্দকার ফজলে রাব্বী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় এপিবিএনসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরের তল্লাশি চৌকি বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচনের দিন কঠোর অবস্থানে থাকবে প্রশাসন। যেন আশ্রিত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পেই অবস্থান করে। এপিবিএন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের সময় রোহিঙ্গা যুবকেরা যেন ক্যাম্পের বাহিরে না যায়, সেজন্য ৩৩টি জমকালো ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হবে। নির্বাচনের দিন ভলিবল খেলার ব্যবস্থাও থাকবে। এক মাস আগে থেকেই নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোনভাবেই যেন রোহিঙ্গাদের এই কাজে জড়ানো না হয় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে।’

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তাদেরকে আসন্ন নির্বাচনে কোনভাবে জড়িয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের তীক্ষ্ম দৃষ্টি রয়েছে এবং জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

মাদক কারবারে পাচারকারী আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে গডফাদার

মায়ানমার থেকে অবৈধভাবে প্রবেশ করা সিগারেট, স্বর্ণের বার, ইয়াবাসহ...

নরসিংদীতে বজ্রাঘাতে মা-ছেলেসহ ৪ জন নি’হ’ত

নরসিংদী প্রতিনিধি: নরসিংদীতে জমিতে ধান কাটার কাজ করার সময় বজ্রাঘাতে...

সংবাদ প্রকাশের জের:পাচার কালে জ্বালানী তেল জব্দ:টহলদলের গাড়ীতে হামলা:অধরা চোরাকারবারি

  এম.এ.রহমান সীমান্ত: গত কয়েকদিন ধরে দৈনিক গণসংযোগ পত্রিকায় ববস্তুনিষ্ঠ ও...

সিরাজগঞ্জ ২১৬ কেজি গাঁজাসহ ০২ জন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার, কাভার্ড ভ্যান জব্দ।

  মোঃ লুৎফর রহমান লিটন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জে র‌্যাব-১২’র অভিযানে...