পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ুর উষ্ণতা, গ্রীন হাউজ ইফেক্ট ও বাংলাদেশ

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২০

 

কোনো ব্যবস্থার ওপর কার্যকর বাহ্যিক প্রভাবকসমূহের সমষ্টিকে পরিবেশ বলে। যেমন: চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও জৈব উপাদান ইত্যাদির সামষ্টিক রূপই হলো পরিবেশ। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের দ্বারাই একজন ব্যক্তি বা প্রাণী এমনকি উদ্ভিদ প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই প্রভাবকসমূহের মধ্যে থাকে প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পারিপার্শ্বিক উপাদানসমূহ।

সৃষ্টিকর্তা এই জাগতিক পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এক মহাপরিকল্পনার অংশ বিশেষ করে। তাই তাঁরই সৃষ্টি জগত প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলমান অবিরত। প্রাকৃতিক নিয়মে চলমান এই পৃথিবীতে চলছে প্রকৃতিতে বিস্ময়কর পরিবর্তন। প্রতিনিয়ত ঘটে চলা এই পরিবর্তনে হুমকির সম্মুখীন অসংখ্য প্রাণীকুল। ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রাণীকুলের অসংখ্য প্রজাতি। আমাদের চর্তুপাশে আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি তাহলেই খুঁজে পাব এ পরিবর্তনের সাথে কত নিবিড়ভাবে জড়িত সৃষ্টির সেরা জীবখ্যাত মনুষ্যজাতি।এসব পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রীষ্মকালের পরিধি বৃদ্ধি, অপরদিকে শীতকালের পরিধি হ্রাস পেয়েছে দৃশ্যমান হারে। অন্যদিকে শুধু যে বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে এমন না অন্যান্য মৌসুমেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে ব্যাপক, এর ফলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দিচ্ছে। এ সবই প্রকৃতির বিস্ময়কর পরিবর্তনের ফলে ঘটছে। এ পরিবর্তন এর জন্য গবেষকরা মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেছেন, বিশেষজ্ঞরা গবেষণার মাধ্যমে যে ফলাফলগুলো পেয়েছেন তার বেশিরভাগই মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করে।

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত সমাস্যা একটি মারাত্মক সমাস্যা।নিজেদের অবহেলার কারনেই প্রতিদিন আমরা চারপাশে তৈরি করছি বিষাক্ত পরিমন্ডল, নিজেদের ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি এক নিঃশব্দ বিষক্রিয়ার মধ্যে। ফলে ঘটছে পরিবেশের মারাত্মক অবনতি, যা আমাদের জীবন, জীবিকা ও বেঁচে থাকার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরুপ। একসময় বাংলাদেশ ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি। এ দেশের মাঠ, ঘাট, পাহাড়, পর্বত, নদী-নালা, বায়ু সবকিছু ছিল নির্মল ও বিশুদ্ধ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মনুষ্য বাসের বা প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার পরিবেশের প্রধানতঃ তিনটি উপাদান মাটি, পানি ও বায়ু নানা উপায়ে দূষিত হচ্ছে। এ দূষন আমরা ঘটাচ্ছি কখনো জেনে বা কখনও অবচেতন মনে।

‘গ্রীন হাউজ’ বলতে বোঝায় কাচের ঘর। শীতপ্রধান দেশগুলোতেও শাকসবজি এবং ফলমূল চাষ করার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় কাচের তৈরি এক ধরনের ঘর । সূর্যের আলোর সাহায্যে এই ঘরের ভেতরে চাষ করা হয় সবুজ শাকসবজি এবং ফলমূল। গ্রীনহাউজ ছোট আকারের বারান্দা থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প কারখানার সমান ও হতে পারে।
কাজ বা প্লাস্টিকের তৈরি এই ঘরের ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করে কিন্তু সূর্যের আলো থেকে উৎপন্ন তাপ ঘরের বাইরে বের হতে পারে না। এই তাপশক্তি কাচের প্লাস্টিকের দেওয়ালে গিয়ে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় ঘরের ভেতরে ফিরে আসে যার ফলে বাইরের পরিবেশের তুলনায় ঘরের ভেতরের পরিবেশ অনেকটা গরম থাকে। আর এই গরম পরিবেশে উৎপন্ন করা হয় গাছপালা এবং সবুজ শাক-সবজি। যেহেতু শীতপ্রধান দেশ গুলোর আবহাওয়া শাকসবজি জন্মানোর জন্য উপযোগী নয় তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে উদ্ভিদের উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হয়।
বায়ুমন্ডলে উপস্থিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং অন্যান্য কিছু গ্যাস বায়ুমন্ডলের সর্বনিম্ন স্তর অতিক্রম করে এর উষ্ণতা বৃদ্ধি করতে থাকে। কিন্তু এই উৎপাদিত তাপ যখন ট্রপোস্ফিয়ার থেকে পুনরায় বায়ুমন্ডলে ফিরে যেতে চায় তখন বায়ুমণ্ডলের স্তর দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় গ্রীন হাউস ইফেক্ট।

পৃথিবীতে আগত সূর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের দ্বারা প্রতিফলিত হয় কিন্তু এর বেশিরভাগই শোষিত হয় পৃথিবীপৃষ্ঠ দ্বারা। বিকিরিত ইনফ্রারেড এর কিছু রেডিয়েশন মহাশূন্যে চলে গেলেও জলীয়বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন পৃথিবী দ্বারা শোষিত হতে থাকে এবং এটি পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলিতে পুনরায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠ আরো বেশি উষ্ণ হয়ে পড়ে।
‘গ্রীন হাউস ইফেক্ট’ শব্দটির উৎস নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে মনে করা হয় যে ফরাসি গণিতবিদ জোসেফ ফুরিয়ার সর্বপ্রথম গ্রীন হাউস ইফেক্ট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কার্বন ডাই অক্সাইড জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, কঠিন বর্জ্য, গাছ এবং অন্যান্য জৈব পদার্থের দহন ও নির্দিষ্ট রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। জীবাশ্ম জ্বালানি এবং কল কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ মোট গ্রীনহাউজ গ্যাসের প্রায় ৬৫ শতাংশ।

কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন এবং পরিবহনের সময় মিথেন উৎপন্ন হয়। এছাড়াও পচা ডোবায় এবং জমিতে পড়ে থাকা জৈব বর্জ্য পদার্থের পচনের মাধ্যমে মিথেন বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীতে মিথেন নির্গমনের হার প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষি এবং কল কারখানার পণ্য উৎপাদনের সময় জীবাশ্ম জ্বালানি ও কঠিন বর্জ্য পদার্থ এর মাধ্যমে উৎপন্ন হয় নাইট্রাস অক্সাইড যার নির্গমনের হার প্রায় ৬ শতাংশ।
এছাড়াও হাইড্রোক্লোরিক কার্বন, সালফার এবং নাইট্রোজেন ট্রাইক্লোরাইড তরল গ্রীনহাউস গ্যাস হিসেবে বায়ুমণ্ডলের নির্গত হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে যেভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যেতে পারে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি সারা পৃথিবীতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে পরিচিত যা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি এবং বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মরু অঞ্চলের বরফ গলে পৃথিবীর নিচু অংশগুলো প্লাবিত হবে খুব অচিরেই।

পরিবেশের প্রতিটা উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। এই সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায় এবং পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়। পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর সাথে দায়ী। পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ১২টি মারাত্মক রাসায়নিক দ্রব্যকে একত্রে ডার্টি ডজন বা নোংরা ডজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই ১২টি রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে ৮টি কীটনাশক অলড্রিন (aldrin), ডায়েলড্রিন (dieldrin), ক্লোরডেন (chlordane), এনড্রিন (endrin), হেপ্টাক্লোর (heptachlor), ডিডিটি (DDT), মিরেক্স (mirex), এবং টক্সাফেন (toxaphene); দুটি শিল্পজাত রাসায়নিক দ্রব্য পিসিবি (PCBs) এবং হেক্সাক্লোরোবেনজিন (hexachlorobenzene); এবং অন্য দুটো হলো কারখানায় উৎপন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত উপজাত: ডাইওক্সিন (dioxin) এবং ফিউরান (furan)। খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পৃথিবীব্যাপী সব পরিবেশের সব ধরনের জীবজন্তুর উপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটায় এই বিষাক্ত পদার্থগুলো। ত্রুটিপূর্ণ শিশুর জন্ম, ক্যান্সার উৎপাদন, ভ্রুণ বিকাশের নানাবিধ সমস্যার মূলেই দায়ী থাকে এই ডার্টি ডজন।

গত ০৭ অক্টোবর-২০২০, বুধবার সন্ধ্যায় ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের একটি ভার্চুয়াল কনফারেন্সে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জলবায়ুর ক্ষতি ঠেকাতে না পারলে বহু মানুষ পৃথিবীতে জলবায়ু উদ্বাস্তু হবে, যার ভার পৃথিবী সইতে পারবে না। এছাড়া, জলবায়ুর ক্ষতি কমাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রতিবছর অন্তত ১০০ বিলিয়ন বরাদ্দের আহ্বান জানান তিনি।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) চেয়ার বান কি মুন, সিভিএফ দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, কপ-২৬-এর আয়োজক ও সহ-আয়োজক যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, ইতালি ও নেদারল্যান্ডস; সিভিএফ থিমেটিক অ্যাম্বাসেডরদের উক্ত ভার্সুয়াল সংযোগে যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, নগরায়ন, অবাধে বৃক্ষ নিধন এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতার অভাবে আমাদের বর্তমান পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। কলকারখানাও যানবাহনের নানা রকম ক্ষতিকারক গ্যাস, বিভিন্ন শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য প্রভৃতির কারনে বাংলাদেধের পরিবেশ আজ মারাত্মক হুমকির সম্মূখীন।অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যাচ্ছে, বাড়ছে বাতাসে সিসার পরিমান, বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির পক্ষীকূল ও বনজ প্রানী। নদীতে পানি দূষনের ফলে ধীরে ধীরে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।ফলশ্রুতিতে পরিবেশ হচ্ছে দূষিত হারিয়ে ফেলছে পরিবেশের ভারসাম্য, হারিয়ে যাচ্ছে জৈব বৈচিত্রের সম্ভার।

পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন বাতাসে যদি কার্বন্ডাই অক্সাইড ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এরফলে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের গড় তাপনাত্রা যদি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তাহলে উত্তর গোলার্ধের বরফ গলে উঁচু হয়ে উঠবে সাগরের পানির স্তর। আর বহু কোটি টন কয়লার ধোয়া আর ধুলাবালি যদি প্রাণ শক্তি প্রদেয় সূর্যালোককে পৃথিবীতে পৌছাতে বাধা দেয় তবে তার ফলাফলও হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।যদি এ কারনে পৃথিবীতে আলো আসার পরিমান বর্তমানের তুলনায় ১.৫% থেকে ২% ভাগও কমে যায়, তাহলে ক্রমে মেরু অঞ্চলের চিরস্থায়ী বরফ ছড়িয়ে পড়বে বিষুব অঞ্চল পর্যন্ত। আর পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে প্রবল শীতের মৃত্যুর পরশ।

সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্লাবনজনিত ক্ষতির সম্নুখীন হতে পারে বাংলাদেশের প্রায় ১২০ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল।এ-ই উচ্চতা যদি ১ ইঞ্চিও বৃদ্ধি পায়, দক্ষিণের দ্বীপগুলো ও সুন্দরবনের ২০% চলে যাবে সাগর গর্ভে। এতে করে উল্লেখযোগ্য হারে প্রাণি ও উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংশ হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনে বর্ষার সময় অতি বৃষ্টিতে বন্যার প্রকোপ বাড়বে পক্ষান্তরে শীত মৌসুমে দেশের প্রধান প্রবাহমান নদীর গতি প্রবাহ কমে যাবার আশংকায় থাকবে বাংলাদেশ। ধন্যবাদ।
সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ পত্রসমুহ ও বিভিন্ন জার্নাল।
এম আর আয়াজ রবি।
(লেখক, কলামিষ্ট ও মানবাধিকারকর্মী)।

সীমান্তবাংলা/ ৮ অক্টোবর ২০২০