সী-লাইন, কক্সলাইন,সিএনজি, টমটমসহ উখিয়ার অন্যান্য যানবাহনের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নৈরাজ্য এবং হালাল (রোজির) আয়ের আমজনতার অসহনীয় দূর্ভোগ!-যেন দেখার কেউ নেই!!

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২০

 

বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায়, পরিবহন মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপুর্ণ অনুসংগ। চাকা বা যান্ত্রিক যান আবিস্কারের পর থেকে মানব সভ্যতার উন্নতির চাকাও ঘুরতে থাকে অবিরত। মানব সভ্যতার উন্নতির পেছনে বিজ্ঞানের বিশ্বয়কর আবিস্কারের একটি হচ্ছে যানবাহন আবিস্কার। এটিই মানব সভ্যতার আজকে যুগান্তকারী উন্নতি সাধিত হবার পেছনে এক যুগ থেকে অন্য যুগের উজ্জ্বল সেতু বন্ধন রচনা করে চলেছে। তাই যানবাহন আবিস্কারকে মানব সভ্যতার ‘মাইল স্টোন’ বলে অভিহিত করা হয়।

গত প্রায় দু’মাস পুর্বে সরকার করোনা পরিস্থিত উন্নতি সাপেক্ষে ও সাধারন জনগনের ভোগান্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে, প্রত্যেকটি যানবাহনের জন্য করোনা পুর্ব ভাড়ায় ফিরে যাবার ( ৬০% অরিতিক্ত ভাড়া লোপ করার ) নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে পরিলক্ষিত হচ্ছে, দেশের প্রায় প্রতিটি বাস, মিনিবাস ও অন্যান্য যানবাহনগুলো সেই অতিরিক্ত ভাড়া প্রত্যাহার করে করোনা পুর্ব ভাড়ায় ফিরে গেলেও, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার সী-লাইন, কক্সলাইন,সিএনজি, টমটমগুলো অনেকাংশে করোনাকালীন ভাড়া হাতিয়ে নেবার বাস্তব প্রমান পাওয়া গেছে।

করোনাকালীন উখিয়া থেকে কক্সবাজার ও কক্সবাজার থেকে উখিয়া পুর্বের ৪০টাকা ভাড়ার ৬০% বৃদ্ধি করে ৭৫ টাকা করা হয়েছিল। করোনাকালীন সময়ে সিএনজি গুলো উখিয়া থেকে কক্সবাজার ও কক্সবাজার থেকে উখিয়া জনপ্রতি ১০০ টাকা নির্ধারন করেছিল। উখিয়া থেকে কুতুপালং, কুতুপালং থেকে উখিয়া জনপ্রতি ২০ টাকা নির্ধারন করে দিয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা ও নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার সুবাদে আমজনতা তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে পুর্ব ভাড়ায় ফিরে যাবার ( ৬০% অরিতিক্ত ভাড়া লোপ করার ) নির্দেশনা পাবার পরেও, সী-লাইন, কক্সলাইন সার্ভিসে উখিয়া থেকে কক্সবাজার, কক্সবাজার থেকে উখিয়া পুর্বের ৪০ টাকা ভাড়ার পরিবর্তে জনপ্রতি ৫০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, আবার সিএনজি গুলো উখিয়া থেকে কক্সবাজার পুর্বের ৮৫ টাকায় ফিরে না গিয়ে করোনা সময়ের ১০০ টাকা বহাল রেখেছে এবং উখিয়া থেকে কুতুপালং পুর্বের ১০টাকা ভাড়ায় ফিরে না গিয়ে করোনা সময়ের ২০ টাকা ধরে রেখেছে। উখিয়া থেকে কোট বাজার সিএনজি ভাড়া ৫০ টাকা আবার কোট বাজার থেকে ইনানীর ভাড়া ৫০ থেকে ৭০ টাকা হলেও সিএনজি ড্রাইভারগুলো উখিয়া থেকে ইনানী ভাড়া নিচ্ছে ৩৫০ টকা থেকে ৪০০ টাকা। আবার কিছু টমটম লোকাল বেসিস চলে, উখিয়া থেকে কুতুপালং জনপ্রতি ১০ টকা নিলেও উখিয়া পুর্ব ষ্টেশন থেকে পশ্চিম ষ্টেশন গেলেও ১০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কারন তারা অঘোষিত নিয়ম করে ফেলেছে উঠা-নামা ১০ টাকা!

অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, গাড়ির মালিক ও শ্রমিকরা, পরিবহন সেক্টরের এক এক জন আইন প্রনেতা। তারা সবাই নিজস্ব আইনে চলে। তারা দেশের প্রচলিত আইন-কানুন, নিয়ম-নীতির কোন প্রকার তোয়াক্কা করেন না। সরকার যেভাবেই আইন প্রনয়ন করুন না কেন, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবহন সেক্টরের উখিয়া অংশের মালিক শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব আইনে চলেন। “যেন আইন মানি, বিচার মানি-তালগাছ নিশ্চয়ই আমার অবস্থা”! এভাবে ভাড়া নৈরাজ্য ও অরাজকতার কারনে সাধারন জনগনের উপর মারাত্মক অবিচার ও জুলুম চালাচ্ছে পরিবহন সেক্টরের উখিয়া অংশের মালিক ও শ্রমিকরা, কিন্তু কেহ প্রতিবাদ করলে নানা যুক্তিতে তারা গায়ের জোর দেখিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তভোগীরা অনেকেই এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, গাড়ির মালিক পক্ষের অনেকেই কিছুদিন পুর্বেও ড্রাইভার ছিলেন বা দিনে এনে দিনে খায় অবস্থায় কালাতিপাত করেছেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা ‘আলাদ্দীনের চেরাগ’ হাতে নিয়ে গাড়ির মালিক বনে গিয়ে ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে, দেশের প্রচলিত আইন-কানুনকে বৃদ্দাংগুলী প্রদর্শন করে চলছেন। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় অতিসহজে ‘ইয়াবা’ নামক মরণঘাতি ট্যাবলেটের বদান্যতায় রাতারাতি অনেকেই কোটিপতি বনে যাওয়ায়, কালো টাকা সাদা করার নিমিত্তে এখন বড় বড় গাড়ির মালিক হয়ে উঠে বন্ধুর (উচু-নিচু) পথকে মসৃণ পথ মনে করে যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন।

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারনে, ড্রাইভারের সাথে প্যাসেঞ্জারের ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি, গালাগালি, হাতাহাতি, মারামারি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অধিকন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাকুরী করতে আসা চাকুরেদেরকে ছয় পাঁচ চৌদ্দ যেমন বুঝাচ্ছে, ঠিক স্থানীয় হালাল আয়ের লোকজন নানাবিধ হয়রানী ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মনে হচ্ছে এসব যানবাহনের নিয়ন্ত্রন করার জন্য অত্র উপজেলা, জেলা বা দেশে কোন সংস্থা, আইন শৃংখলা বাহিনী, থানা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় নেতা নের্তৃ বলতে কেহ বা কিছুই নেই!যান বাহন মালিক-শ্রমিক কর্তৃপক্ষ যেন ‘সরকারের উপর অন্য সরকার’, তারা সরকারী দলীয় লোক, নেতা-নের্তৃ ও তাদের পৃষ্টপোষকতায় এতমাত্রায় বেড়ে গেছেন যে, তাদের সাথে কথা বলার সাহস বা আগ্রহ কেহই দেখাতে পারছেন না। তারপরও স্থানীয় শিক্ষিত সচেতন যাত্রী ভাড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ড্রাইভাররা রীতিমত মারমুখী আচরন করছে। এসব ভাড়া নৈরাজ্য, অরাজকতা, অবৈধ হয়রানী তারা দিনের পর দিন করে যাচ্ছে কিন্ত দেখার যেন কেউ নেই!যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের শক্তি ও খুঁটীর জোর কোথায়, উখিয়া বাসী জানতে চায়। ভোক্তভোগী অনেকেই এ প্রতিবেদককে বলেছেন, তারা এই ভাড়া নৈরাজ্য ও অরাজকতা করার সাহস পাবার মুল খুঁটী হচ্ছে, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, থানা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন- তারা এসব নিয়ন্ত্রন করে বা প্রভাব কাটিয়ে, সরকার দলীয় নেতা সেজে জনগনের পকেট কাটার উর্ধ্বত্য দেখাবার সাহস দেখাচ্ছে।

এখানে প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে গত মার্চ মাসে করোনার প্রকোপ চোখে পড়ার পর থেকে করোনার কারণে দীর্ঘদিন যাবতীয় যানবাহন বন্ধ থেকেছিল। কিন্তু সীমিত পরিসরে (করোনার যথাযথ নিরাপদ দুরত্ব বজার রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে) গণপরিবহন চলাচলে কিছু শর্তআরোপ করে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। ৬৬দিন লকডাইন শেষে গত ১ জুন থেকে শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সে নিয়ম মালিক-শ্রমিক কেউ স্বাস্থ্য বিধি ও নিরাপদ দুরত্ব মানেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। শুরু থেকেই ‘যাত্রী কম’ এই দোহাই দিয়ে -৬০ থেকে ১০০ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয় ঐ সময়। আর হ্যান্ডস্যানিটাইজার বা গাড়ি স্প্রে করার কথা পরিবহন শ্রমিকরা ভুলেই গেছিলেন। শুরুতে কয়েকদিন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বদলে দেয়া হতো রঙিন পানি।

ভাড়া বাড়ানোর প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লা রুটে বাস বা মিনিবাস চলাচলের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ২০১৬ সালের ৩ মে প্রজ্ঞাপনমূলে উল্লেখিত বিদ্যমান ভাড়ার (যাত্রীপ্রতি কিলোমিটার সর্বোচ্চ ১.৪২ টাকা) ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছিল।
যদিও বা বাস-মিনিবাসের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছিল ‘ভোক্তা অধিকার সংস্থা’ (সিসিএস বা কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি)। উক্ত কনজুমার্স সোসাইটি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কম যাত্রী নিয়ে বাস-মিনিবাস পরিচালনার জন্য মালিকদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি জনগণের ওপর না চাপিয়ে সরকারি প্রণোদনার আওতার্ভুক্ত করারও দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু উক্ত ৬০% অতিরিক্ত ভাড়া জনগনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সরকার করোনা কালে আয়হীন, কর্মহীন, অভাব, দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত নিঃস্ব সাধারণ আম জনতার উপর ভাড়ার অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল যা ঠিক যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে প্রতিভাতিত হচ্ছিল।

কোভিড-১৯ এর মধ্যে সাধারণ মানুষের উপার্জন কমেছে। লাখ লাখ মানুষ কর্ম ও আয়হীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলের খড়গও সইতে হচ্ছিল সাধারন জনসাধারণকে। ইতিমধ্যে বহু বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কমানো হয়েছে। অনেকের চাকুরী চলে গেছে, আয়-রোজগারের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাস ভাড়া বৃদ্ধির যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল তা জনসাধারণের ওপর মারাত্মক জুলুম ও অবিচারের সামিল বলে দেশের সাধারন জনগন মনে করেছেন।

উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনা করতঃ মাননীয় ইউএনও, ওসি, নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়গণ ও উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়, উখিয়া ও ৪ নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় বিভিন্ন দলের, সংগঠনের নেতা-নের্তৃর সুদৃষ্টি কামনাপূর্বক বিভিন্ন যানবাহনের অতিরিক্ত ভাড়া নৈরাজ্য, হয়রানী ও ভোগান্তি বন্ধ করার অতি দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করে উখিয়ার আপামর জনসাধারনকে ভাড়া নৈরাজ্য ও হয়রানী থেকে মুক্ত করার বিনীত আবেদন রইল। নচেৎ, দিনে দিনে ভোক্তভোগীরা অশান্ত ও মারমুখী হয়ে উঠলে, পরিবেশ-পরিস্থিতি সামাল দেওয়া প্রশাসনের পক্ষে কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে উঠার সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে।

এম আর আয়াজ রবি।
(লেখক, কলামিষ্ট ও মানবাধিকারকর্মী)

প্রকাশঃ ১৯ অক্টোবর ২০২০