মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ইবনে সিনা 

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৩, ২০২২
ইউসুফ আরমান ;
মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ইবনে সিনা মননের গভীরতা, চিন্তাশক্তির বিশালতা ও বিশ্ব জনীন উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশ্বের সুধীর সমাজে বিশেষ ভাবে সুপরিচিত। তিনি এরিষ্টটলের দর্শনের একজনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকর। আল-কিন্দি ও আল-ফারাবী ইসলাম শিক্ষার সঙ্গে এরিষ্টটলের দর্শেনর যে সামঞ্জস্য বিধানের কাজ আরম্ভ করেন। ইবনে সিনা তা সুসম্পন্ন করেন। তাঁর চেষ্টা মুসলিম জগতের এরিষ্টটলের দর্শন চর্চা চরম উৎকর্ষ লাভ করেন। এরিষ্টটলীয় দার্শনিকদের মধ্যে ফারাবীর লেখাই ইবনে সিনা কে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল। বস্তুত মৌলিক চিন্তাবিদ ফারাবীর রচনাই তাঁকে এরিস্টটলের দর্শনের অনুশীলনের উদ্বুদ্ধ করেছিল। এরিষ্টটলের ভাষ্য রচনায় তিনি ফারাবীর রচনা কে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনে
পূর্ণাঙ্গ নামঃ- আবু আলী আল হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা।
পিতার নামঃ- আব্দুল্লাহ
মাতার নামঃ- সিতারা
জন্মঃ- ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ
জন্ম স্থানঃ- ইরানের বুখারার আফসানা নামক স্থানে।
মৃত্যুকালঃ- ১০৪৭ খ্রিঃ (৫৭ বছর) এ তিনি শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করেন।
কৈশোরে হাকিম উপাধিতে ভূষিত হন।
শিক্ষা জীবনঃ- গৃহের পরিবেশই বাল্যশিক্ষা, দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম, রাজনীতি, প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। ১০ বছর বয়সেই তিনি কোরআন শরীফ শিক্ষা গ্রহণ এবং আরবী ভাষা আয়ত্ত করেন। অল্প বয়সেই তিনি অসামান্য মেধা ও প্রখর স্মৃতিশক্তি বলে বহু বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ইবনে সিনা এক ধেয়ানী বিচার অধ্যুষিত আবেষ্টনীর মধ্যে বেড়ে উঠেন।
১৬ বছর বয়সেই ইবনে সিনা প্রসিদ্ধ চিকিৎসাবিদগণ চিকিৎসা শাস্ত্রের ও তার অভিনব চিকিৎসা প্রণালিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতেন। এই ষোল বৎসর বয়সেই ইবনে সিনা সামানীয় সুলতান নূহ ইবনে মানসুরের (৯৭৬-৯৭৭) খ্রিঃ এক কঠিন রোগ নিরাময় করেন এবং তার রাজটিকিৎসক নিযুক্ত হন। এই সময়ে ইবনে সিনা মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও আইন বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। একদিন বুখারায় আবু আব্দুল্লাহ আন নাতালি নামক একজন বড় দার্শনিকের উপস্থিতি ঘটে। ইবনে সিনা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার নিকট থেকে এরিষ্টটল, টলেমি ও ইউক্লিডের গ্রন্থরাজি অধ্যয়ণ করেন। অল্পকালের মধ্যে শিষ্য গুরুকে অতিক্রম করলেন। এরপর তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং চিকিৎসা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
ইবনে সিনার প্রতিভা ছিল অসামান্য। জীবনে বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়েও তিনি বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। ঐতিহাসিক আল বিফতির ‌‌‌‌‌‌‌‌‌”তারিখুল হুকামা” গ্রন্থে ইবনে সিনার একুশখানির সুবৃহৎ এবং চব্বিশখানি ক্ষুদ্র গ্রন্থের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আরবী ও ফারাসি উভয় ভাষাতে তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, জ্যামিতি, গণিত, জ্যোতিষ, ইলমুল কালাম, ভাষাতত্ত্ব, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি একজন কবি ছিলেন। ইবনে সিনার জ্ঞান সাধনা ও সাফল্য যে কোন যুগের ডে কোন জাতির গর্বের বস্তু। তাঁর প্রতিভা যে কোন মনীষির পরম শ্রদ্ধার বিষয়। ইসলামের ভক্ত কবি হাকিম সানাই চার লাইনের পংক্তিতে উদ্ধৃতি দেন
“আমি দুনিয়ার বা জান্নাতের কোন নিয়ামত চাই না;
সম্পদে হোক বিপদে হোক সর্বদাই আমি এই প্রার্থনা করি-
“হে আল্লাহ, সানাই কে তুমি দর্শনে ও বিজ্ঞানে এতোখানি অধিকার দাও
যা দেখে বু আলী সিনার চিত্তে হিংসা জাগে”।
দর্শনঃ- ইবনে সিনার দর্শন বিভিন্ন দর্শনের সমন্বয়। তিনি তার পূর্ববর্তী লেখকদের মতবাদ সমূহের সম্পর্কে সমালোচনামূলক গ্রন্থ লেখার পরিবর্তে পুরাতন মতবাদ সমূহের নতুন ভিত্তি দান করেন। ইবনে সিনা ছিলেন তার যুগের সত্যকার প্রতিনিধি। আল ফারাবীর ন্যায় তিনি বাস্তব জীবন থেকে দূরে সরে গিয়ে এরিষ্টটলের ভাষ্য রচনায় মশগুল থাকেন নি; তিনি এরিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে প্রাচ্যের জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করা দর্শনের সাধন করেন। তাঁর মতে, দর্শন ও ধর্ম পরস্পর স্বতন্ত্র। বিশ্বাস ও যুক্তির সমন্বয় সাধন করা দর্শনের কাজ নয়; বরং প্রজ্ঞার সাহায্যে জীবন জগতের পরম সমস্যাবলির ব্যাখ্যাদান করাই দর্শনের মূল লক্ষ্য। অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে ও জ্ঞান লাভ করা যায় সত্য, কিন্তু সে জ্ঞান দর্শনের মত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান নয়। পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জ্ঞান একমাত্র দর্শনের চর্চার মাধ্যমেই পাওয় যায়। কাজেই দর্শনের অনুশীলন প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য।
যুক্তিবিদ্যাঃ- যুক্তিবিদ্যা মানসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে, পদার্থবিদ্যা জাগতিক অস্তিত্ব সম্পর্কে এবং অধিবিদ্যা আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে। যুক্তিবিদ্যা মানসিক ধারণা সমূহ (Mental Concept) আলোচনা করে। বাস্তব অস্তিত্ব থেকে বিমূর্তীকৃত (Abstrcated Freom Realities) এই সকল ধারণার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই, এদের অস্তিত্ব মানসিক। ইবনে সিনার যুক্তিবিদ্যা আর ফারাবীর যুক্তিবিদ্যা থেকে অনেক পৃথক এমন নয়। ইবনে সিনার মতে, চিন্তা করার সময় মানুষ প্রায়ই ভুল করে থাকে। শুধু যুক্তিবিদ্যার অনুশীলনের মাধ্যমে চিন্তার এই ভ্রান্তি নিরসন করা যায়। বৃদ্ধিবৃত্তি যৌক্তিক ক্রমবিকাশের মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করা সম্ভব। কেবল ঐশী প্রেরণালদ্ধ ব্যক্তিরাই যুক্তিবিদ্যার সাহায্য ছাড়া প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারেন, কেননা তাদের জ্ঞান স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রত্যক্ষ।
মনোবিজ্ঞানঃ- ইবনে সিনা দেহ ও মনের দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। দেহের সঙ্গে আত্মার কোন অনিবার্য সম্পর্ক নেই। সমস্ত দেহ নক্ষত্রের প্রভাবে আতিম বা মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। তবে মানবদেহে এই মৌলক উপাদান সমূহের সূক্ষ্ম সমাবেশ ঘটেছে। মনুষ্যত্বের অন্যান্য জীবদেহ অপেক্ষা মানবদেহে মৌলিক উপাদান সমূহের নিখুঁত সমন্বয় ও সংযোগ ঘটেছে। আত্মা আকস্মিকভাবে দেহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছে- আত্মা দেহের কোন অনিবার্য অংশ নয়। বিশ্ব আত্মা থেকে সকল দেহ আত্মাপ্রাপ্ত হয়। সূচনা থেকেই আত্মা ব্যক্তিগত সত্তা এবং দেহের অবস্থানকালে আত্মা উত্তরোত্তর স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে থাকে।
পদার্থবিদ্যাঃ- ইবনে সিনার মতে, জড় নিস্ক্রিয় ও নিশ্চল। জড় সৃষ্টিধর্মী নয়, গ্রহণধর্মী, শক্তি একমাত্র সক্রিয় সত্তা এবং সব কিছুর কারণ শক্তি সমস্ত ক্রিয়ার মূল। এই জড়জগতে অগণিত শক্তি(Spirit) রয়েছে যা তিনি নিম্ন থেকে উচ্চতরে সাজিয়েছেন। যেমন- প্রাকৃতিক শক্তি, উদ্ভিদ ও জীবের ক্ষমতা, মানব-আত্মা এবং বিশ্ব-আত্মা।
অধিবিদ্যাঃ- অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে ইবনে সিনা আল ফারাবী থেকে স্বতন্ত্র। কারণ তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি কে পার্থিব শক্তির বহু উর্ধ্বে উন্নিত করেছেন এবং আধ্যাত্মিক ও পার্থিব স্তরের মধ্যবর্তী শক্তি হিসেবে আত্মার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইবনে সিনা খোদা থেকে জড়ের অনুমান করেন নি। খোদ শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক সত্তা, তিনি সমস্ত শক্তির উর্ধ্বে। জড় শক্তি ও আধ্যাত্মিক শক্তির ব্যবধান ঘুচিয়েছে আত্মা। আত্মার জড়াত্মক ও আধ্যাত্মিক উভয়বিদ শক্তি সমন্বয় সাধিত হয়েছে, আত্মার দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিক রয়েছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, ইবনে সিনা শুধু তাঁর যুগের চিন্তাধারার অধিনায়কই ছিলেন না,  বরং তাঁর মতবাদ সমূহে আধনিক দর্শনের বিশিষ্ট লক্ষণ ও আভাসিত হয়েছে।
লেখক পরিচিতি
ইউসুফ আরমান
কলামিষ্ট ও সাহিত্যিক
ফাজিল, কামিল
বি.এ অনার্স, এম.এ, এলএল.বি
দক্ষিণ সাহিত্যিকাপল্লী
বিজিবি স্কুল রোড় সংলগ্ন
০৬ নং ওয়ার্ড, পৌরসভা, কক্সবাজার।
০১৮১৫৮০৪৩৮৮/০১৬১৫৮০৪৩৮৮