মিয়ানমারের উষ্কানিতেই রোহিঙ্গাদের মাঝে সংঘাত। অডিও বার্তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২০

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা কেন এখন সশস্ত্র সংঘাতে জড়াবে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারাই শুধু নয়, এ প্রশ্ন এখন ওই অঞ্চলের আশ্রয়শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গাদেরও। বিভিন্ন সময় গুঞ্জন ছিল, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সংঘাতের নেপথ্যে স্বার্থান্বেষী মহল, বিশেষ করে, মিয়ানমারের ইন্ধন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া একটি অডিও বার্তা ঘিরে সেই সন্দেহ নতুন করে দানা বাঁধছে।

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট, সংক্ষেপে আইসিসি), আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতসহ (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, সংক্ষেপে আইসিজে) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কাঠামোতে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়নের জবাবদিহি নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে মিয়ানমার ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের জন্য এককভাবে ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের’ হামলাকেই দায়ী করে থাকে। আইসিসি, আইসিজেসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি যখন এই রোহিঙ্গা শিবিরের দিকে, তখন রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতকে উদ্দেশ্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকেই।
টেকনাফের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে তিন দিন ধরে বহুল আলোচিত একটি অডিও বার্তা কালের কণ্ঠ’র হাতেও এসেছে। ওই অডিওতে কথা বলা রোহিঙ্গার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া না গেলেও অনেকেই বলেছেন, তিনি কুতুপালং ৭ নম্বর মেগা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মাস্টার নুরুল বশর। রাখাইনের মংডুর বাসিন্দা নুরুল বশর অডিও বার্তায় দাবি করেছেন, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে অব্যাহত মারামারি ও খুনাখুনির নেপথ্যে রয়েছে মিয়ানমারের মদদ। মিয়ানমার কৌশলে কুতুপালং শিবিরের সন্ত্রাসী গ্রুপ ‘মুন্না বাহিনীর’ প্রধান মাস্টার মুন্নাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য নগদ টাকা-পয়সাসহ যাবতীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে। মুন্না রাখাইনের মংডুর নাফফুরা এলাকার বাসিন্দা। একই এলাকার রোহিঙ্গা নেতা জহির আহমদ মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকারের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। জহির আহমদের রাখাইন নাম হচ্ছে অংজাউন। তিনি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ‘থাব্বে’ (রাজাকার বা দালাল) হিসেবে পরিচিত।

অডিওতে নুরুল বশরকে বলতে শোনা যায়, রোহিঙ্গা নেতা জহির আহমদ ওরফে অংজাউন রাখাইনে একজন এমপি (পার্লামেন্ট মেম্বার) প্রার্থী ছিলেন। এ কারণে তাঁর সঙ্গে মিয়ানমারের সরকারের উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বসবাস করেন মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে জড়িত একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের হয়ে সে দেশে ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত জহির। কুতুপালং শিবিরের সন্ত্রাসী গ্রুপ নেতা মাস্টার মুন্নার সঙ্গে তাঁর রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেই সূত্র ধরে মিয়ানমার সরকারের হয়ে রোহিঙ্গা নেতা জহির টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য যাবতীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছেন মুন্নাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুন্না গ্রুপের কয়েক শ সদস্য রয়েছে। কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া এলাকাটিতেই বাহিনীর একচেটিয়া আধিপত্য। বাহিনীর এতগুলো সদস্যের হাতে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা সাধারণত একজন সাধারণ রোহিঙ্গার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে মাসিক একটি নির্ধারিত অঙ্কের টাকাও দেওয়ার তথ্য সবার জানা। অডিও বার্তায় যদিওবা মাস্টার নুরুল বশর মিয়ানমারের দেওয়া টাকায় মুন্না তাঁর বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে মাসিক ১৯-২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার দাবি করেছেন।
খোঁজখবর নিয়ে আরো জানা গেছে, আইসিজে গত জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার সরকারকে বেশ কয়েকটি অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ক্রমশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এর আগে শিবিরগুলো মূলত এক প্রকার শান্ত ছিল। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে, আইসিসি সংশ্লিষ্ট কোনো তদন্ত দল কক্সবাজার এলেই রাতারাতি রোহিঙ্গা শিবিরগুলো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখনই শিবিরগুলোতে পরষ্পরবিরোধী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় খুনাখুনির ঘটনাও।

সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখার কাছাকাছি এলাকায় মিয়ানমার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করার নেপথ্যের অন্যতম কারণ বলেও জানা গেছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের দমনে যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করবেন, তখন হয়তোবা সন্ত্রাসীরা নিজেদের রক্ষায় সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যাতে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় সে জন্যই মিয়ানমারের অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন। তদুপরি আইসিসিতে মিয়ানমারের কয়েকজন সেনার দোষ স্বীকারের বিষয়টি নিয়েও ভাবিয়ে তুলেছে দেশটিকে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে সহজে না হয় সেটা মাথায় রেখেও মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে বলে সীমান্তের নানা সূত্রে জানা গেছে।

গত কয়েক দিন ধরে আইসিসি সংশ্লিষ্ট একটি দল রোহিঙ্গা নির্যাতনের গোপনীয় তদন্তের কাজ চালাচ্ছে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এসব বিষয়ে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আন্দোলনের অন্যতম নেতা নুর মোহাম্মদ সিকদার গতকাল বুধবার গনমাধ্যমকে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের কূটকৌশল বুঝে ওঠা বেশ কঠিন। মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের মদদ দিয়ে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চায়—রোহিঙ্গারা বাস্তবে একটি সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠী এবং তারা নিজেদের দোষেই দেশ ছেড়েছে।’

সুত্রঃ কালের কন্ঠ