বানর হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বন্যপ্রাণী সহ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার দাবীতে মহেশখালীতে সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশ’র মানবন্ধন ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

মহেশখালীতে মহাবিপন্ন প্রজাতির বানর হত্যার প্রতিবাদে “বন্যপ্রাণীর প্রতি সহিংসতা রুখো” স্লোগানে বানর হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও মানববন্ধনের আয়োজন করে সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কার্যনিবাহী সংসদ। সকালে বানর হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন পূর্বক বিকেলে মহেশখালী উপজেলা চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান আ.ন.ম. মোয়াজ্জেম হোসেনের সভাপতিত্বে ও ওয়ান অবলিগ টোয়েন্টিফোর সোশ্যাল মুভমেন্টের এনভায়রনমেন্ট এন্ড বায়ুডায়বারসিটি উইং লিডার সাধারন রুমানা রিফাত রিমকির সঞ্চালনায় অনুষ্টিত হয়।

এতে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ ককসবাজার জেলার সিনিয়র সহ সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন আবু ও আ.ন.ম. হাসান, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন ককসবাজার জেলার নেতা ও সাবেক ছাত্র নেতা মনির মোবারক, সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ ককসবাজার জেলা সহ:সাধারন সম্পাদক মো:নেজাম ফারাব্বী, ওয়ান অবলিগ টোয়ান্টিফোর সোশ্যাল মুভমেন্টের সভাপতি জামাল উদ্দীন, সমাজকর্মী মনির উদ্দিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহেশখালী উপজেলা সাধারন সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মহেশখালী উপজেলা সাধারন সম্পাদক প্রিন্স প্রান্ত, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ মহেশখালী উপজেলা সাধারন সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফ,

সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ টেকনাফ উপজেলা সভাপতি জালাল উদ্দীন, ফায়সাল উদ্দীন প্রমুখ।

নেতৃবৃন্দ বলেন গত ১১/১০/২১ তারিখ বিকেল আনুমানিক ৫:৩০ মিনিটের সময় মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালীর ভারিতিল্লা পাহাড়ী ঘোনা যা মুদিরছড়া বন বিটের অধীনস্থ পাহাড় মহেশখালী মৌজায় মহাবিপন্ন প্রজাতির শতাধিক কুলু বানর/শুকর লেজি বানর (Northern pig-tailed Macaque) কে কলার সাথে বিষ মাখিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরিকল্পিত ভাবে একসাথে এতগুলো বন্যপ্রাণী হত্যা, যা এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যপ্রাণী হত্যাকান্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছে । এতে গত ১৭/১০/২১ তারিখে মুদিরছড়া বিট কর্মকর্তা অঞ্জন কান্তি বিশ্বাস বাদী হয়ে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষন ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৩৯ ধারা মোতাবেক মামলা দায়ের করেছেন। অথচ এখনো অব্দি মামলার কোন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়নি। তাছাড়া বন বিভাগের করা মামলাতে ভিন্ন প্রজাতির বানর যা (Macaca Mulatta) বলে উল্লেখ করেছে। যার ফলে পোষ্টমর্টেম রিপোর্টের সাথে এই অঞ্চলে বিচরন করা বানরের প্রজাতির ভিন্নতা থাকায় এই হত্যাকান্ড প্রমান করা অসম্ভব। তাই চিহ্নিত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী গবেষক দ্বারা এই বানরের প্রজাতি তাদের প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিত করে আর্জি সংশোধন করার বক্তারা জোর দাবী জানান।

 

মহেশখালী দ্বীপ যখন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল তখন এই দ্বীপে হাতি, বাঘ, হরিণ, বানর, ভাল্লুক, বিভিন্ন প্রকারের সাপ ও জীবজন্তু, সামুদ্রিক কাছিমের প্রকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র, পরিযায়ী পাখি, দেশীয় পাখি, বিভিন্ন ধরনের মাছ সহ সমৃদ্ধ প্রকৃতিক ইকোসিস্টেম ছিল যা এখন ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়েছে। হারিয়ে গেছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী। এখন কিছু হরিণ, বানর, সাপ এবং অল্প পরিযায়ী পাখি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাই এই দ্বীপের পরিধির ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক ও অক্ষত রেখে দ্বীপের পরিবেশ প্রকৃতি জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিকল্প নেই।

 

বনজ, ফলজ ও ঔষধী বৃক্ষ সমূহের বেশ কিছু বীজ আছে যাদের অঙ্কোরোদগম প্রাকৃতিক ভাবে হয়না, পরিপক্ষ বীজ মাটিতে পড়লে বা রোপন করলেই তা থেকে শেখড় গজায়না, চারা ফুটেনা, গাছ হয়না, আর গাছ হলেও তাতে ফুল এবং ফল হয়না। তাই সেই সব বীজ থেকে চারা সৃষ্টি হবার জন্য জীবজন্তু পশুপাখির বিকল্প নেই। তারা সে সব ফলমূল খেয়ে বনের বিভিন্ন স্থানে মলত্যাগ করলে সে মলে থাকা বীজ থেকে চারা গজানোর যে জার্মিনেশন সিস্টেম তার জন্য বন্যপ্রাণী ও পশুপাখির ইকোসিস্টেম ঠিকিয়ে রাখার বিকল্প নেই।

 

বঙ্গোপসাগরের বুকে ধীরে ধীরে জমে উটা পলির স্তর সমৃদ্ধ হলেই তা ভূখন্ডে পরিনত হয়না, তারও একটি ইকোসিস্টেম আছে। দ্বীপের চরে প্রানের সাথে বৃক্ষের সেতুবন্ধন রচনা করে পশুপাখি – জীবজন্তু, তারা এক এলাকা থেকে ফলমূল খেয়ে অন্য এলাকাতে এসে মলত্যাগ করে আর সেই মল থেকে চারা গজায় আর সে চারা বড় হয়ে সেখানে ফুলে ফলে ভরিয়ে তুলে আর গড়ে তুলে একটি প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম। সেখানে কেউ বাসা বুনে, কেউ আশ্রয় নেয়, কেউ খাদ্য সংগ্রহ করে, আর সে গাছ কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহন করে অক্সিজেন ত্যাগ করে আর মাটির ক্ষতিকর উপাদান শুষে নিয়ে মাটি ও পানিকে নিরাপদ রাখে। তাই গাছ পাতা ফুল ফল পাখি বন মাটি পানি সকলেই এই ইকোসিস্টেমকে টিকিয়ে রাখে। যাদের কোন একটি উপকরন পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলে তা রিনিউ করা অসম্ভব, আর তার সাথে সাথে তাকে ঘিরে গড়ে উটা খাদ্যচক্র ও শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ে। আর এভাবেই পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টির মাধ্যমে মানবসভ্যতা হুমকির মুখে পড়ে। তাই আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সেটাই আমাদের পরিবেশ, তার কোন উপাদানের গুন আপনি অস্বিকার করার সুযোগ নেই। তাই পরিবেশকে তার মত ঠিকিয়ে রাখার মাধ্যমে মানবসভ্যতা নিরাপদে ঠিকে থাকতে পারে।

 

মানবদেহের জন্য সংবেদনশীল সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক তৈরীর ক্ষেত্রে গবেষনার মূল্যবান মডেল এই প্রজাতির বানর সমূহ। সংবেদনশীল রোগ সমূহের প্রতিষেধক চুড়ান্ত প্রস্তুতি নিশ্চিৎ করতে মানবদেহের বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ এই প্রানী বা (অমানুষ প্রাইমেট) এর উপর পরিক্ষামূলক সংক্রমন জড়িত গবেষনা ছাড়া কখনো সম্ভব হতনা। মানবসভ্যতার ধারা স্বাভাবিক ও নিরাপদ বিকাশে মানব জাতি ওদের কাছে চিরকাল ঋনী হয়ে থাকবে। যুগে যুগে পৃথিবীতে সৃষ্ট ভয়াবহ সংক্রামক রোগের হাত থেকে মানবসভ্যতাকে নিরাপদ করতে তাদের বলিদানের ফসল আজকের সুস্ত আধুনিক বিশ্ব।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে এইডস, পোলিও, যক্ষা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ক্লামিডিয়া, ম্যাকাক নেমেষ্ট্রিনা, সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক ট্রায়াল, স্নায়ু বিজ্ঞানের গবেষনা, ভ্যাকসিন উন্নয়ন, বায়োমেডিক্যাল গবেষনা, ফার্মাসিটিক্যালস গবেষনা, পোলিও ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত প্রজাতি সনাক্ত করা প্রয়োজন যার ফাইলোজেনেটিক সম্পর্ক ও প্রজাতির জেনেটিক এবং জিনোমিং কাঠামো সমৃদ্ধ। বিভিন্ন এন এইচ পি প্রজাতি সংক্রমন রোগের প্রতিরোধ বা সংবেদনশীলতার সাথে জড়িত হোষ্ট ফ্যাক্টর গুলোর উপর মূল্যবান তথ্য প্রদান করে। রেট্রো ভাইরাস যেমন HIV এর জন্য টিকা পরিক্ষামূলক ছাড়া সম্ভব হতনা। এটি অমানবিক প্রাইমেট ভাইরাস গুলোর জন্য উচ্ছ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। যেমন সিমিয়ান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (SIV), সিমিয়ান হিউম্যান চিমেরিক ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস ও HIV / এইডস গবেষনায় বিশেষ আগ্রহের কারন এই উল্টোলেজি (Northern Pig-tailed Macaque) প্রজাতির বানর।

 

অথচ ২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা- আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রাণীর লালতালিকা অনুযায়ী এ কুলু বানর (Northern Pig-tailed Macaque) বাংলাদেশে বিপন্ন (Endangered) শ্রেণীর অন্তর্গত। পৃথিবী ব্যাপী এ বানর প্রজাতি সংকটাপন্ন (Vulnerable) প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত, দক্ষিণ এশিয়ায় বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্ন হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে । বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রাণীর লাল তালিকা অনুযায়ী দেশে এ বানরের মোট সংখ্যা ১০০০ এর কম এবং ক্রমেই এদের সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশের বেশ কিছু জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণী অভায়ারন্য ছাড়াও বেশ কিছু দুর্বল ভাবে সংরক্ষিত বনে এদের দেখা যায়। এই বছর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সাতছরি বনে এদের মোট সংখ্যা মাত্র ১১৭ টি (১৩ টি কম বা বেশী হতে পারে)।

 

মহেশখালীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দাবী সমূহ:

১। এই প্রজাতির বানরের আবাসস্থলকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষনা করা।

২। এই বনে বানর সহ বন্যপ্রাণীর চাহিদা উপযোগী খাদ্যশৃঙ্খল গড়ে তোলা ও তাদের অন্যতম পচন্দ আম, আনারস সহ বন্য ফলের বৃক্ষ সৃজনের উদ্যোগ গ্রহন করা।

৩। সরকারের অনুমতি ব্যাতিত যে কোন ধরনের কৃত্রিম খাবার প্রদান ও তাদের উপর কোন ধরনের গবেষনা না করা।

৪। এই বানরের আবাসস্থলের পরিপার্শ্বিক কোন ধরনের ক্ষতি হয় এমন কেন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন না করা।

৫। এই বানরের আবাসস্থলের আশেপাশে যে সব গাছে ফুল হয়না, ফল হয়না, পাখি বা বন্যপ্রাণী আস্রয় নিতে পারেনা এই ধরনের বৃক্ষ যেমন আকাশমণি ইউক্যালিপটাস জাতীয় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বৃক্ষ সৃজন থেকো বিরত রাখা।

৬। ঐ অঞ্চলের ইকোসিস্টেমের সাথে সহায়ক এমন কোন ধরনের বৃক্ষ নিধন থেকে বিরত রাখা।

৭। ঐ অঞ্চলে এই প্রাণী সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা ও মহল্লা ভিত্তিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষনে সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলা।

৮। তাদের বিচরন ক্ষেত্র ও তৎসংলগ্ন এলাকায় কোন ধরনের কৃষিকাজ বা শষ্য উৎপাদন না করে বরং প্রাকৃতিক বনের ইকোসিস্টেম সমৃদ্ধ করা।

সীমান্তবাংলা/রম/০৫ নভেম্বর ২০২১