পাবনার ১১ শহীদ পরিবার রাষ্ট্রীয় সম্মাননা থেকে বঞ্চিত

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও পাবনা সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের চর আশুতোষপুর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালীন নির্মম হত্যার শিকার ১১ শহিদ পরিবার আজও সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসেনি। এমনকি তাঁদের খোঁজ-খবর নেয়নি কেউ; তারা বঞ্চিত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা থেকেও। নিহতদের পরিবারের অনেকেই বর্তমানে মানুষের বাড়িতে ঝিঁ হিসেবে এবং ইটভাটায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

জানা গেছে, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের (১৯৭১ সালের) ৭ আশ্বিন মাঝনদীতে নিয়ে এ ১১জনকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। তাঁদের অপরাধ ছিল বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প করা। ঐ এলাকায় সরেজমিন পর্যবেক্ষণে গেলে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় থাকা মকসেদ আলী ও শহিদ পরিবারের সদস্যরা জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ক্যাম্প করা হয়। এ নিয়ে এলাকার রাজাকার বাহিনীরা পাকবাহিনীদের নিকট খবর দেয় যে, মাহাম শেখের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করা হয়েছে। ঘটনার দিন আশুতোষপুর গ্রাম থেকে সকাল ১১টায় ১৩ জন নৌকাযোগে পাবনা শহরতলীর পাশে হাজির হাটে যান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলী আকন্দকে পাবনা হাজির হাট এলাকায় হত্যা করার জন্য অভিযান চালালে বন্দুকের গুলি না বের হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা এদিক-সেদিক চলে যান। পরে রাজাকার বাহিনী প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি শুরু করে। পরে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকসেনারা (হাজির হাটের পাশে) নদীর দিকে যায়। এদিকে হাটের কাজকর্ম শেষ করে ঐ ১১জন পুরুষ বিকেল ৩ টার দিকে বাড়ি ফেরার জন্য নৌকায় ওঠেন। এ সময় রাজাকাররা ঐ ১১জনকে পাকবাহিনীকে দেখিয়ে দিলে তারা তাঁদেরকে আটক করে। ঐদিনই পাকহানাদাররা রাত ১২টার দিকে তাদের গুলি করে হত্যা করে হাজির হাটের দক্ষিণে (যেটাকে নদীর কোল বলা হয়) মাঝনদীতে নিয়ে ফেলে দেয়।

এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা ২ শিশুকে ছেড়ে দেয় পাকবাহিনী। পরদিন সকালে এলাকার লোকজন ১১জনের লাশ উদ্ধার করে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন। নিহতরা হলেন কফেজ উদ্দিন শেখ, মাহাম শেখ, আজগর আলী শেখ, কুটু খাঁ, কুরান শেখ, কামাল মালিথা, গুলাই শেখ, আমোদ আলী মোল্লা, তাছের ব্যাপারি, নদু সরদার ও হোসেন মণ্ডল। শহিদদের মধ্যে হোসেন মণ্ডলের স্ত্রী খোদেজা খাতুন পার্শ্ববর্তী ইটভাটায় কাজ করছেন। কালাম মালিথার স্ত্রী সাইমুন নেছার পেটে টিউমার হয়ে গতবছর চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন । শহিদ গুলাই ব্যাপারির মেয়ে জাহানারা আক্তার কান্নাজড়িত কন্ঠে গণধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আমার বাবা পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর থেকে আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। দেশের বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছেন, সেখানে আমরা আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি সহযোগিতা পাওয়া তো দুরের কথা, আমাদের খোঁজ-খবর পর্যন্ত কেউ নেয়নি। শহিদ কফেজের নাতি নবাব আলী এবং অপর একজন শহিদের ছেলে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পেলেও আমাদের পরিবারে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে থাকার পরও আমরা তা পাইনি। এমনকি আমাদের পরিবারের খোঁজ-খবরও কেউ নেয়নি।’

এ-সকল শহিদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সুদৃষ্টি কামনা করেন এলাকাবাসী ।

মকসেদ আলী আরও বলেন, ‘গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর এলাকার একটি নির্বাচনী সমাবেশে তাদের এলাকার ১১ জন শহিদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয়। সেটা আজও বাস্তবায়ন হয়নি, কবে নাগাদ হবে সেটাও কেউ জানে না। সরকার যদি আমাদের এলাকার এই শহিদদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে কিছু করে তাহলে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।’

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক আজিজুর রহমান টিংকু বলেন, ‘যে ১১জনকে রাজাকার বাহিনী সেদিন নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল, তাঁরা প্রকৃতই শহিদ, তাঁদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া দরকার। আমি এ বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তাঁরা বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ পাবনা শাখার সভাপতি ও বীরমুক্তিযোদ্ধা আ. স. ম আব্দুর রহিম পাকন বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃতই শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর নেওয়া প্রয়োজন। এঁদের খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’