দ্রব্য মূল্যের ’পাগলা ঘোড়া’ ও মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তসহ প্রান্তিক মানুষের বোবা কান্না-যেন দেখার কেউ নেই!

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২২

 

এম আর আয়াজ রবি;

বর্তমানে ‘টক অব দ্যা কাউন্ট্রি’ হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি। কালোবাজারী, মুনাফাখোর, মজুতদার প্রভৃতি কারণে খাদ্যদ্রব্য, চাল,ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে মানুষের আয় রোজগারের পথ সীমিত হয়ে পড়েছে, জনজীবন আজ পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত। হাজার হাজার মানুষ করোনা মহামারীর কারনে কর্মহীন হয়ে পড়েছে, দেশের চাকুরীর বাজারের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মানুষের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি ও অর্থনৈতিক চাকাগুলো একে একে স্লথ বা বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্প, প্রবাসী রেমিটেন্স প্রবাহের পথ সংকুচিত হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি যেখানে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, সেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করছে। মানুষের একটু ভালোভাবে বাঁচার দাবি আজ সর্বত্র। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে ‘পাগলাটে অশ্বের ন্যায়’ দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে প্রতিটি পণ্যের মূল্য।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন ওষ্টাগত। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে, মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এখন পর্যন্ত বেতন ভাতাদি সঠিক সময়ে, ঠিকভাবে উত্তোলন করতে পারলেও, বেসরকারী চাকুরীজীবিদের মধ্যে চলছে রীতিমত হতাশা ও আতংক। কার কখন চাকুরী চলে যায় বা প্রতিষ্টান কখন বন্ধ হয়ে যায়!

এখানে উল্লেখ্য যে, দেশে মোট চাকুরে পরিসংখ্যানে সরকারি চাকুরের সংখ্যা মোট চাকুরের সংখ্যার ৫% বা তার নিচে! বাকি ৯৫% বেসরকারি চাকুরে প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয়ে চাকুরীর অনিশ্চয়তায় আবার বাড়ি ফেরেন। যেন তার চাকুরীটা বালিশের নিচেই গচ্ছিত থাকে! শত প্রতিকুলতার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তবে এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, গত ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি কমেছে এমন ১৫টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক, সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম নেই। ওই ১৫টি দেশে যে গতিতে দারিদ্র্য কমেছে, বাংলাদেশে কমেছে এর চেয়ে কম গতিতে।

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন পাগলাঘোড়া বেপরোয়াভাবে তছনছ করে দিচ্ছে জীবনযাত্রা। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অদম্য লোভ, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার সিন্ডিকেট, সরকারের আশকারা এবং নিষ্ঠুর নির্লিপ্ততা। বাজারে গিয়ে সাধারন মানুষ দ্রব্যমুল্যের লাগামহীনতা দেখে বলতে বাধ্য হন, বাজার মনিটরিং এর জন্য কোন কর্তৃপক্ষ আছে কিনা বা দেশে কোন সরকার আছে কিনা? মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষোভ নিরসনের পরিবর্তে নেতানেত্রীরা এসব নিয়ে মশকারা করে যাচ্ছেন নিরন্তর! দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কাছে জনগণ অসহায় হয়ে পড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে দু-তিন গুণ, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে—মন্ত্রীরা এমন সব বক্তব্য দিয়ে দরিদ্র মানুষের সঙ্গে তামাশা করেন। বিরোধী দল ইতিমধ্যে বলেই দিয়েছেন, মানুষ এখন বলা শুরু করেছে, বাজারে এলে মনে হয় না, দেশে কোনো সরকার আছে! বাজার নজরদারির কোনো কার্যক্রম নেই সরকারের। তারা আরও বলেন, ‘মন্ত্রী ও সরকারি নেতাদের কথা শুনলে লোকজন লজ্জা পায়। এক মন্ত্রী বলেন, মানুষের আয় বেড়েছে তিন গুণ, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ কথাকে সংশোধন করে মন্ত্রী, নেতাদের উদ্দেশে বলতে চাই, সাধারণ মানুষের নয়, আপনাদের আয় বেড়েছে। আর তা বেড়েছে ৩০০ গুণ।’ তারা আরও বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব পণ্যের ওপর আরও এক মাস পর পড়বে। তা–ও সব পণ্যের মূল্য বাড়ার কথা নয়। এখন সিন্ডিকেট সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে দাম বাড়িয়েছে।’
গত ১২ বছরে দ্রব্যমূল্যের ঘোড়া লাগামহীনভাবে বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে তা আকাশচুম্বী হয়েছে। এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়েছে যে সাধারণ মানুষ তা ছুঁতে পারছে না। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সেবা এবং জ্বালানির মূল্য। হাসপাতাল, পরিবহন, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও প সর্বত্রই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এর দাম। যানবাহনে ১২ বছরে ভাড়া বেড়েছে অন্তত ১২ গুণ। উৎপাদনের সাথে সেবা খাতের অপরিহার্য সম্পর্ক রয়েছে। যখন তেলের দাম বাড়ে তখন সব কিছুরই দাম বাড়ে। আর এ দেশের ব্যবসায়ীরা বেপরোয়াভাবে শাকসবজি থেকে শুরু করে সব কিছুরই দাম বিনা দ্বিধায় বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

দ্রব্যমূল্যের কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কথা বলা হয়। কিন্তু শাকসবজির মতো যেসব দেশজ দ্রব্যাদি রয়েছে তার মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা কী? আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে কখনোই তা কমে না। যেমন কয়েক মাস আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে তখন এখানে দাম কমেনি। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। সে কারণে সরকার অচিরেই আর একদফা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা কষতে পারে। তখন সেটি আর বাংলাদেশের মানুষের সহ্য সীমার মধ্যে থাকবে না। উল্লেখ্য, যে গত বছর সরকার যখন অযৌক্তিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন ভুক্তভোগীরা বাধা দিয়েছিল। সরকার সে বাধা মানেনি ফলে অর্থনীতির সনাতন নিয়মানুযায়ী পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় বেড়েছে। সেই সাথে সেবা খাতগুলো- বিদ্যুৎ, পানি,গ্যাস ও পরিবহনসহ প্রায় সবকিছুর দাম বেড়েছে। সরকার বিভিন্ন সেবা খাতে ভর্তুকি প্রদান করছে। সব সেবা খাতের সব ব্যক্তি যে এই ভর্তুকি পাচ্ছে তা নয়; বরং সেখানেও দলবাজি। বেছে বেছে সেই শাহেদরাই লাভবান হয়েছে। অথচ এই ভর্তুকি পাওয়ার কথা লাখো কোটি গরিব মানুষের। আজকে টিভির খবরে দেখতে পেলাম,সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানীতে শুল্কহার প্রত্যাহার করে মুল্য কমানোর চেষ্টা করবেন। দেখাযাক সামনে রমজান আসন্ন। রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মুল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্টীসহ নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্তের বোবাকান্না বন্ধ করার প্রদক্ষেপ নিতে পারা যায় কিনা।

লেখকঃ প্রেসিডেন্ট-বাংলাদেশ জাতীয় সাংবাদিক ফোরাম ( BNJF) উখিয়া উপজেলা শাখা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট-উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া।