কারাগারে বঙ্গবন্ধুর পড়া না পড়া বই

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২১

লেখক :কবি ও গবেষক :: কারাগারে বঙ্গবন্ধুর পড়া না পড়া বই (পঞ্চাশের দশক) খুঁজতে গিয়ে একটা বিষয় বারবার মনে এসেছে, বারবার গ্রেপ্তার, বারবার নির্যাতন করে যাকে দমানো যায়নি তিনি হলেন- বাংলার মাটি মানুষের মুজিব। বারবার প্রাণ সমর্পণ করেছেন তিনি শুধু একটি জাতির মুক্তির নেশায়, স্বাধীনতার নেশায়। ১৯৫৪ সালে কারাগারে থাকা কালে তাঁর লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ পড়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের ইচ্ছা তাঁর কত আগে থেকেই মনে জন্ম নিয়েছিল।

১৯৫৮ সালে আয়ুব খান সামরিক শাসন ‘মার্শাল ল’ জারি করলে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলো ১২ অক্টোবর ১৯৫৮।

পরিবারের লোকজন বেশ উদ্বিগ্ন, কেননা সামরিক শাসন বেশ কড়া করে ঘরে ঘিরে রেখেছে সবাইকে। রাজনীতি বলতে গেলে পুরপুরি বন্ধ করে দিয়েছে নিমিষের মধ্যেই।

এর মধ্যে সে মাসেই ২৭ অক্টোবরের একটি দরখাস্তে দেখা যাচ্ছে এফ. নেসা স্বাক্ষরিত ডি. আই. জি. (আই. বি) বরাবর বঙ্গমাতা আবেদন জানাচ্ছেন যে, তাঁর স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁদের পূর্বে বসবাসকৃত টি-বোর্ডের বরাদ্দকৃত বাসাটি কর্তৃপক্ষ ওই মাসের ৩০ তারিখের মধ্যেই ফাঁকা করে দিতে বলেছে। এ অবস্থায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে তাঁর জরুরি সাক্ষাৎ প্রয়োজন।

৩০ অক্টোবর ৪.৩০ মিনিটে তিনি (বঙ্গমাতা) জেলগেটে দেখা করলেন মুজিবের সঙ্গে, এবং সেখানে আই. বি তাঁদের দেখার বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন- পারিবারিক আলোচনা হয়েছে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি।

 

পরের মাসে ১০ নভেম্বর ফজিলাতুন নেসা অর্থাৎ বঙ্গমাতা ডি.আই.জি বরাবর আরেকটি আবেদন করেছেন- জেলে তাঁর স্বামী শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করবেন সঙ্গে থাকবে ১) হাসিনা- ১০ বৎসর ১১ মাস (সম্ভাব্য) ২) কামাল- ৮ বৎসর ১০ মাস (সম্ভাব্য) ৩) জামাল- ৫ বৎসর ৮ মাস (সম্ভাব্য) ৪) রেহেনা- ২ বৎসর ১১ মাস (সম্ভাব্য) এবং মমিনুল হক, তাঁর স্বামীর ভাই এবং মি. আবুল হুসাইন, তাঁর স্বামীর পূর্বতন ব্যক্তিগত সহকারী। এর সঙ্গে জেলে তিনি আরেকটি আবেদনও রেখেছেন, যা ১২ নভেম্বর এর একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে-বঙ্গমাতা কতগুলো বই জেলগেটে দিয়েছেন যা জেলের মধ্যে মুজিবকে পৌঁছে দেয়ার জন্য, তারমধ্যে ৬ খানা বই জেল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিয়েছেন পৌঁছানোর জন্য, যথাক্রমে-

১ সেলফ রেস্ট্রেইন্ট,

সেলফ ইনডালজেন্স,

(২) ইন দ্য হাই ইয়েমেন,

(৩) সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি,

(৪) সিক্সটি ডেজ ইন আমেরিকা,

(৫) মরুতীর্থ হীংলাজ,

(৬) পথে প্রবাসে।

২৯ নভেম্বর ১৯৫৮, জেলগেটে ফজিলাতুন নেসা অর্থাৎ বঙ্গমাতার সঙ্গে মুজিবের আরেকটি জরুরি সাক্ষাৎ। সেই রিপোর্টে গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন যে- তাঁদের আলোচনার সময় উঠে এসেছে- শেখ মুজিবের পরিবার, তাঁরা এখন সিদ্ধেশ্বরীর যেখানে বসবাস করছেন সেখানে চারপাশে জঙ্গল এবং সে বাড়িতে কোনো পানির ব্যবস্থা নেই, বসবাসের অযোগ্য। ভাড়া বাড়ি খোঁজার জন্য অনেককেই যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কেউ শেখ মুজিবের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিতে সাহস পাচ্ছে না। পিস্তল ও বন্দুক লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে চলেছে। যেগুলো থানায় জব্দ আছে কি না তাও নিশ্চিত না। বাড়ির জমির কিস্তি পরিশোধ করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন এবং কিস্তির এগ্রিমেন্ট সংক্রান্ত কাগজ পত্র থানায় জব্দ করে রেখেছে পুলিশ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এবং ২৪ এপ্রিল ১৯৫৯, আরেকটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সেখানে শেখ মুজিব নিজে ডি. আই. জি. (আই. বি.) বরাবর একটি এপ্লিকেশন দিয়েছেন, যেখানে বলা হচ্ছে জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিম্নোক্ত বই গুলি তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুনন্নেসা ৭৬, সেগুণ বাগিচা এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। যথাক্রমে বই গুলির নাম

১. চক্রবাক- রমেশ চন্দ্র সেন,

২. কাশ বনের কন্যা- আবুল কালাম শামসুদ্দিন,

৩.মরুতীর্থ হীংলাজ- আবদুত,

৪. প্রেম ও পরিনয়- জে গার্ডার,

৫. উলটোরথ।

ধারণা করা যায় এগুলি হয়ত মুজিব পড়া শেষে তাঁর বাসা-বাড়িতে ফেরত পাঠাচ্ছেন।

২৪ আগস্ট ১৯৫৯ এর আরেকটি গোয়েন্দা রিপোর্টে দেখা যায়-কাজিন মোমিনুল হক একখানা বই জেল গেটে পাঠিয়েছেন, বইটির নাম-‘ভারতে মাউন্ট ব্যাটেন’ – অ্যালান ক্যাম জনসন। কিন্তু বইটি জেল কতৃপক্ষ কর্তৃক সেন্সরড হওয়ায় তা আর জেলের মধ্যে পৌঁছাতে পারে নাই।

৪ ডিসেম্বর ১৯৫৯ এর আরেকটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ৪ নভেম্বর ১৯৫৯ এ শেখ মুজিবের স্বাক্ষরে জেল কর্তৃপক্ষের নিকট তাঁর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য একটি আবেদন এবং ওই সাক্ষতের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীর নিকট আই. বি. অফিসারের উপস্থিতিতে নিম্ন উল্লেখিত বই গুলো ফেরত দিতে চান। ধারণা করা হচ্ছে এগুলো তিনি পঠনপূর্বক বাসা-বাড়িতে ফেরত পাঠাতে চাচ্ছেন।

বই গুলি যথাক্রমে-

১. সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি,

২. ইন দ্য হাই ইয়েমেন,

৩. বন হংসী,

৪. উল্কা,

৫. স্বাগতম,

৬. সুয়োরাণী,

৭. রাত্রির তপস্যা,

৮. না,

৯. বিচারক,

১০. রানী সাহেবা।

এর কিছুদিন পরই ১৭ ডিসেম্বর ১৯৫৯ এ যাত্রায় মুজিব জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন প্রায় দেড় বছর পর। ২৮ ডিসেম্বর এর একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে মুজিব জেলে থাকাকালীন সময়ে ১১ খানা খাতা লিখেছিলেন এবং এই ১১ খানা খাতার মধ্যে ৩ খানা খাতা আটকে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ সেন্সরড করা হয়েছে। আর বাকি আট খানা খাতা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

আটকে দেয়া ৩ খানা খাতা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে-

১) ‘এলিফ্যান্ট এক্সারসাইজ বুক’- পেজ ১৯-২৪ ক্রিটিসিজম এগেনেস্ট অ্যা পুলিশ অফিসার ………….।

২) ‘রেডিও এক্সারসাইজ বুক’- পুরোটাই জেল এডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ক।

৩) ‘বাউন্ড রেড এক্সারসাইজ বুক’- পেজ ৭-১৩ ইন্টারন্যাল ডিস্পিউট অব আওয়ামী লীগ পার্টি।

[Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-5, pages- 172, 179, 201, 340, 411, 521-522 & vol-4, page 63, 259

এর পূর্বে ভলিউম চার (১৯৫৪-১৯৫৭), ২৪ জুন ১৯৫৪ এর একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ১৭ জুন জেলখানায় মুজিবের নিকট নিম্নোক্ত এই বই গুলি পাঠানো হয়েছে।

১) টেন এছেস অন ফ্রেন্স রেভুলিউশন, অনুবাদ উইলিয়াম জ্যাক,

২) শনিগ্রহ ও পৃথিবী- আবু জাফর শামসুদ্দিন।

প্রথম বই খানা ‘টেন এছেস অন ফ্রেন্স রেভুলিউশন’ বইটি কম্যুনিস্ট সাহিত্যের, বিশেষত ফ্রেন্স কমিউনিস্ট পার্টি বিষয়ক বলে বই খানা উইথেল্ড করা হয়। দ্বিতীয় বই খানা ‘শনিগ্রহ ও পৃথিবী’ নাটকের বই। এই নাটকে ক্যাপিটালিস্টদের সমালোচনা ও কমিনিজমের প্রশংসা করা হয়েছে বলে এই নাটকের বই খানাও উইথেল্ড করা হয়।

সেবারে মুজিবকে ১৬ জুন ১৯৫৪ গ্রেপ্তার, এবং রিলিজড ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৪ দেখানো হয়েছে।

আর আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুজিব শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বই পড়তেন। যদিও অধকাংশ সময় তিনি জেলে থাকার কারণে তাঁর পছন্দের-অপছন্দের বই গুলো কমই পড়তে পারতেন, কেননা জেলখানায় তাঁর কাছে যা কিছু পাঠানো হতো সবকিছুই পরীক্ষা করে সেন্সরড করা হতো। জেল কর্তৃপক্ষ যা পড়তে দিতে চাইতেন না, তা তিনি পড়তে পারতেন না। শুধু বই-ই না প্রতিটি বিষয়ই মুজিবের কাছে পৌঁছানোর আগে পরীক্ষা করা হতো, একবার (২১.১২.১৯৫৮) হাবিবুর রহমান নামে মুজিবের এক আত্মীয়, মুজিবের জেল থেকে মুক্তির জন্য জেল খানায় মুজিবকে একটি চিঠি সহ একটি তাবিজ পাঠিয়েছিলেন, তাবিজটি সকলের সামনে খুলেব মাইক্রসকোপিক পরীক্ষা পূর্বক ভিতরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চিঠি পত্র, পত্রিকা, বই সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এর মধ্যেও সেন্সরড আনসেন্সরড যাই হোক না কেন, মুজিব বই পড়তেন।

আরও অনেক অনেক তথ্য থেকে দেখা যায়, মুজিব শুধু নিজেই বই পড়তেন না, তিনি জেলের বাইরে থাকা কালে জেলে আটক তাঁর অন্যান্য নেতা কর্মীদের জন্য তিনি জেলের মধ্যে বই পাঠাতেন। ৪ মে ১৯৫৫ তারিখের একটি পত্রে দেখা যায়- ৫৬, সিম্পসন রোডের একটি ঠিকানা থেকে তিনি (শেখ মুজিব) লিখছেন -মাই ডিয়ার মান্নান সম্বোধনে একজন ব্যক্তিকে জেলের মধ্যে (মান্নান নামক ওই ব্যক্তির নিকট) বই পাঠানোর বিষয়ে।

এরকম অসংখ্য দুর্লভ বিষয় থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পেরে মনে হচ্ছে ভয়াবহ সুন্দর একখানা বই পাবলিশড হয়েছে ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রান্স অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন তথ্য উন্মোচনে বার বার আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে অজানার গভীরে।

উপলব্ধি দিয়েছে -মুজিব একবার জন্মানো একটি নাম।

 

এডমিন/ইবনে যায়েদ

সংবাদটি শেয়ার করুন