উ‌খিয়া-টেকনাফ সড়‌কে উখিয়া সদরে ঠিকাদারী কা‌জ দ্বায়সারা

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০

মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বিধ্বস্ত এক অর্থনীতির পুনঃনির্মাণে উঠে পড়ে লেগেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমন এক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল-এক ডলারের রিজার্ভও জমা ছিল না কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। তবুও সাহসী ও পরিকল্পিত নেতৃত্বের কারণে এগিয়ে যাচ্ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘হেনরি কিসিঞ্জার’ অত্যন্ত তাচ্ছিল্য করে বলে বসলেন, বাংলাদেশ এক ‘ইন্টারন্যাশনাল বটম লেস বাস্কেট’ বা ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’। কারণ সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রায় সাত কোটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে যতই বৈদেশিক অনুদান পাওয়া যেত, যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্রে প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত স্বল্প হয়ে প্রতিভাত হয়ে পড়ত। তিনি (হেনরি) স্পষ্ট লক্ষ্য করলেন, এত মানুষ, সামান্য সম্পদ ও এখানকার প্রকৃতি বিরূপ। তাই সদ্য স্বাধীন এ দেশের উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা নেই! সন্দেহ নেই, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের ‘ম্যালথুসিয়ান তত্ত্ব’ এর পুরো রূপায়ণ ও পুনরাবৃত্তি ঘটবে এই বাংলাদেশে!

এর কয়েক বছর পর, বিশ্ব ব্যাংকের দুই অর্থনীতিবিদ ইউস্ট ফাল্যান্ড এবং জন পার্কিনসন এক বইয়ের শিরোনাম করলেন ‘বাংলাদেশ : অ্যা টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’। ভাবখানা এমন, পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামক দেশ উন্নতি করতে পারলে, পৃথিবীর যে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে! এর চেয়ে লজ্জা ও দুঃখের কথা আর কি হতে পারে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে, পুর্বের পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে কি ভুমিকা পালন করেছিল, তা বলাই বাহুল্য! তাই সদ্য স্বাধীন দেশে কেন হেনরি কিসিঞ্জার সাহেব এসব বাজে কথা আওড়াচ্ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা!

হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজকে আমরা স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রম করতে চলেছি। সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অবস্থা থেকে আজ বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’-এ রুপান্তরিত হয়ছে। অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে।
আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ঐতিহ্যবাহী পদ্মা সেতু করতে চলেছি। আমরা আকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি। চট্রগ্রাম থেকে ঘুংধুম পর্যন্ত রেল লাইন চলমান। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ২০০০ ডলার ছাড়িয়েছে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। সুতরাং, একটি দেশের দৃশ্যমান উন্নয়নের মৌলিক ও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক বা অর্জন হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সামগ্রীক দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। অত্র মহা সড়কের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের বাজেট প্রায় ৫শত কোটি টাকা।

প্রায় পাঁচ শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে অত্যন্ত ধীর, কচ্ছপ গতিতে! যেন উক্ত প্রকল্প দেখভালের কেহ নেই, কোন বস্তুনিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই! ঠিকাদারী প্রতিষ্টান নিজের মর্জিমত কাজ করে যাচ্ছে। উখিয়া সদর ষ্টেশন, অত্যন্ত ব্যস্ততম সড়ক ও ষ্টেশন হবার কারনে, যত দ্রুত উন্নয়নমুলক কাজে লোকবল নিয়োগ করার কথা ছিল, যত ধরনের হাই কোয়ালিটির মালামাল ব্যবহার করার কথা ছিল এবং সর্বোপরি যত দ্রুত অত্র প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল, তার কোনটাই পরিলক্ষিত হয়নি। উখিয়ার পুর্বাংশে বাস্তুচ্যুত রোহিংগা জনগোষ্টির আশ্রিত ক্যাম্পগুলো উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত হবার কারনে, প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার বিভিন্ন টাইপের গাড়ির বহর কক্সবাজার হয়ে পুর্বাংশে যাতায়াত করে। চলমান বর্ষা মৌসুমে উক্ত মহাসড়কের অবস্থা যান চলাচলের অনুপযুক্ত থাকার কারনে, প্রতিদিন শত শত গাড়ির জট উখিয়াবাসীকে নাকাল করে তুলেছে।

উখিয়া থেকে কক্সবাজার যাবার পথ প্রায় আধ ঘন্টা বা পৌনে একঘন্টার। কিন্তু উক্ত পথ পাড়ি দিতে কোন কোন সময় ছয় সাত ঘন্টা বা আট-দশ ঘন্টা সময় ও লেগেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কোট বাজার ষ্টেশন ও উখিয়া ষ্টেশন উঁচু করে আরসিসি ঢালাই দিয়েছে। কোট বাজার অংশের কাজ প্রায় কিছুদিন পুর্বে শেষ হয়েছে। উখিয়া অংশ শুরু করেছে আরও অনেক পরে। কিন্তু কাজের গতি ছিল বরাবরই কচ্ছপ গতি।
কক্সবাজার টেকনাফ মহাসড়কের উন্নয়ন কাজের অংশ হিসেবে উখিয়া ষ্টেশনের পশ্চিম পাশ অর্থাৎ উখিয়া উপজেলা গেইটের একটু পুর্ব থেকে একরাম মার্কেটের পুর্ব পর্যন্ত আরসিসি ঢালাই দিয়ে মোটামুটি গাড়ি চলাচলের উপযোগি করেছে কিন্তু উখিয়া সদর ষ্ট্রেশনের প্রধান সড়কের অর্ধেকাংশের কাজ অর্থাৎ একরাম মার্কেট হয়ে পূর্ব ষ্টেশন কেন্দ্রীয় মসজিদের কবর স্থান পর্যন্ত অংশের কাজ দীর্ঘ দিন পর্যন্ত বন্ধ ছিল। জনগুরুত্বপূর্ণ উখিয়া ষ্টেশনের অর্ধেকাংশের কাজ অসমাপ্ত থাকার কারনে, বর্ষা মৌসুমে উখিয়া বাসীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। অল্প বৃষ্টিতে হাটু পানিতে ডুবে থাকে রোডের অসমাপ্ত অংশ। সাধারন জনগন ও রোহিংগা ক্যাম্পে কর্মরত চাকুরীজীবিদের কষ্টের শেষ ছিল না বললেই অত্যুক্তি হবে না। গত ২০-শে সেপ্টেম্বর-২০২০ তারিখে, গ্রাজ্যুয়েট উখিয়া টেকনাফ গ্রুপের ৪ নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সমসাময়িক অবস্থার উপর ভার্স্যুয়াল মিটিং-এ আমন্ত্রিত অতিথি স্পীকার হিসেবে আমি ৪নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে অত্র ইউনিয়ন পরিষদের সম সাময়িক অনেক বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে, উখিয়া সদর ষ্টেশন রোডের পূর্ব অংশের কাজ বন্ধ থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি বৃষ্টির কারনে চলমান কাজ বন্ধ রাখার কথা বলেছেন এবং ঐদিন থেকে কাজ পুনরায় শুরু করার কথা উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু সরেজমিনে কাজের অগ্রগতি আজকে যা দেখলাম, তা অত্যন্ত নাজুক ও হতাশা ব্যঞ্জক। কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর, কচ্ছপ গতিতে হাতেগুণা চার/ পাঁচ জন জন লোক দিয়ে এত বড় প্রকল্পের কাজ চলমান। কাজের কুয়ালিটিও মনে হলে অনেক ইনফেরিয়র। দেখে যা মনে হলে দু’চার জন লোক মিলে যেন লবণ মাঠে বা বিলের জমিতে চাষী চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত। অথচ মহা সড়কের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে প্রায় ৫শত কোটি টাকা ব্যয়ে হচ্ছে, কাজের কোয়ালিটি ও গতি হওয়া উচিত ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের ও উঁচু গতিতে। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, এত বড় উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারী প্রতিষ্টানটির মালিক, নিজেকে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের ভাগিনা পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাঁটিয়ে সড়কের উন্নয়ন কাজে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে কচ্ছগতিতে কাজ চালাচ্ছে! লোকে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে এ ঠিকাদার ওবায়দুল কাদের এর নাম ব্যবহার করেই সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করছে। জনগণের প্রশ্ন সে আসলে কি ওবায়দুল কাদের এর ভাগিনা? নাকি নাম ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে? সড়ক ও সেতু মন্ত্রীর ভাগিনা হলেই কি অনিয়ম করতে পারে ? বা অনিয়ম করে পার পেয়ে যেতে পারে কিনা? এ ব্যাপারে কক্সবাজারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মহোদয়ের সদয় দৃ্ষ্টি কামনা করছি।
কাজের গতি খুবই দুর্বল। বার বার কচ্ছপগতিতেই চলমান কাজ হচ্ছে। দেখার কেউই নেই। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কোন প্রকৌশলী বা দেখভালো নিয়োজিত কারো দেখা মিলছে না! কাজ চলছে ঢিলেঢালা ভাবে। আজকের উখিয়া সদরের প্রধান সড়কের কাজের দৃশ্যের ছবি দেখলেই বুঝা যায়, কিভাবে হচ্ছে কাজই কাজের কোয়ালিটিই বা কি!
গেল কয়দিন ধরে সমানে কখনও হালকা, কখনও মাঝারি বা ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে সর্বত্র পানি,কাদা, জলে টই টম্বুর। কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কের উখিয়া সদর ষ্টেশনে টিকাদারের মিস্ত্রী কাম কথিত প্রকৌশলীর হাতে গোনা কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে চালানো হচ্ছে সড়কের গুরত্বপুর্ণ আইসিসি ঢালাইয়ের কাজ। পানি,ময়লা ও কাদার মধ্যে ঢালা হচ্ছে আইসিসি ঢালাই সামগ্রী। সওজের দায়িত্বশীল কাউকে দেখা যায়নি আশে পাশে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন শত কোটি টাকার কাজে প্রকাশ্যে চলছে লুটপাট।

স্হানীয় সাধারন জনসাধারণ ও বিভিন্ন দোকানদার উক্ত রোডের কাজের বিভিন্ন বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, কিছু বলা যাচ্ছেনা, বলতে গেলেই বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হবে। তাই সবাই দেখলেও কিছু বলার নেই। পথচারীসহ সাধারণ মানুষের উদ্বেগ মহা অনিয়মের মাধ্যমে মহাসড়ক তৈরি হলে কাজের স্থায়ীত্ব নিয়ে জনমনে নানা সংশয় রয়েই যাচ্ছে। উখিয়া সদর ষ্টেশনের এই যদি হয় অবস্হা! সড়কটির অবস্হা দেখলে মনে হয় ময়লা আর্বজনার ভাগাড়। কক্সবাজার – টেকনাফ মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে প্রায় দুই বছর ধরে।
উখিয়ার নেতা নের্তৃ, সুশীল সমাজ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উক্ত মহাসড়কের ব্যাপারে তেমন উচ্চ বাচ্য করতে দেখিনি, এমন জন গুরুত্বপূর্ণ রোডের ষ্টেশন অংশের কাজ এত দিন বন্ধ থাকার পরেও কোন জন প্রতিনিধি এ ব্যাপারে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহন করেনি, কোন প্রতিনিধি অত্র রোডের বেহাল অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্টানের সাথে কথা বলে কাজের গতি বৃদ্ধি করার গরজও অনুভব করেননি । সব ক্ষেত্রে ‘অনিয়মই যেন নিয়মে’ পরিনত হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাই এখন রীতিমত অন্যায় হিসেবে পর্যবশিত হচ্ছে। তাই মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ভুলতে বসেছে। জনগণ আর এহেন জন দুভোর্গ সহ্য করতে পারছে্ন না এই ইস্যুটি নিয়ে খুব গুরুত্বসহকারে নজর দিতে হবে, না হয় উখিয়ার ঊপেক্ষিত,নিপীড়িত,প্রতিবাদি ও শান্তিপ্রিয় মানুষ ঠিক সময়ে ব্যালটের মাধ্যমে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে, তখন শত চেষ্টাতেও আমজনতাকে নিজেদের পক্ষে নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। সেজন্য বলে ‘ সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’। তাই সাধু সময় থাকতেই সাবধান হোন। ধন্যবাদ সবাইকে।

এম আর আয়াজ রবি।
(লেখক, কলামিষ্ট ও মানবাধিকারকর্মী)