এসএমএস-এ ফেল, ৬ মাস পর জানলেন পাশ!

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯

বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ফল বিভ্রাটের কারণে এক মেধাবী ছাত্রীর শিক্ষা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে মূল্যবান একটি বছর। গত ১৭ জুলাই প্রকাশিত এইচএসসি’র ফলাফলে বরগুনা সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তাহিরা খানমকে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হয়। সেই ফলাফলে জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতে অকৃতকার্য দেখানো হয়।

পরের (২০২০ সাল) বছরের জন্য ফরম পূরণের পর তাহিরা জানতে পারেন তিনি কোন বিষয়েই অকৃতকার্য হননি! এমনকি মোট ফলাফলেও ফেল করেননি। তিনি পেয়েছেন জিপিএ-৩.৮৩ (এ-)। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বরিশাল বোর্ডের নম্বরফর্দে (একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট) ৩.৮৩ (এ-) পেলেও তাতে সন্মান রক্ষা হয়নি সদ্য বিবাহিতা তাহিরা খানমের। বোর্ডের ফলে ফেল দেখানোয় শ্বশুড় বাড়িসহ নিজের পাড়া-মহল্লা এবং বন্ধু মহলে নানা তিরস্কারের শিকার হয়েছেন তিনি। যদিও কারিগরি ত্রুটির কারণে এমনটা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. আনোয়ারুল আজিম।

পাথরঘাটা তাছলিমা মেমেরিয়াল একাডেমি থেকে এসএসসি’তে বিজ্ঞান বিভাগে ৪.৮২ পেয়ে বরগুনা সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন পাথরঘাটা পৌর শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন খানের মেয়ে তাহিরা। এইচএসসি’তে ভালো ফল করার জন্য বিজ্ঞান বিভাগের সবগুলো এবং ইংরেজী বিষয়ে প্রাইভেট পড়েন তিনি। গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এইচএসসি’র সবগুলো বিষয় ভালোভাবেই পরীক্ষা দেন তিনি। আশা ছিল ভালো ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। সে লক্ষ্যে পরীক্ষার পরপরই ঢাকায় বাসা ভাড়া করে প্রায় ৩ মাস বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করেন তিনি। ফল প্রকাশের মাসখানেক আগে পাথরঘাটার একটি সভ্রান্ত পরিবারের এক শিক্ষিতি ছেলের সাথে তাহিরাকে বিয়ে দেন তার পরিবার।

কিন্তু গত ১৭ জুলাই এইচএসসি’র ফল প্রকাশের দিন তাহিরার জীবনে নেমে আসে হতাশার ছায়া। বাড়ি বসে সরকারী মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানী টেলিটকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে তাহিরা জানতে পারেন তিনি অকৃতকার্য হয়েছেন। শুধু তাই নয়, যে বিষয়গুলোর উপর দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছেন সেই জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতে অকৃতকার্য হয়ে মোট ফলে তিনি নাকি ফেল করেছেন।

তাহিরার বড় ভাই ফেরদৌস খান ইমন জানান, এক বিষয়ে ফেল করলেও উত্তরপত্র পুনমূল্যায়নের আবেদন করতেন তারা। কিন্তু ৩ বিষয়ে ফেল দেখে তারাও আর উত্তরপত্র পুনমূল্যায়নে আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু অদম্য বোন কোনভাবেই তার অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। তিনি আবারও এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এর কয়েক দিন আগে তার বিয়ে হয়। সব কিছু মিলিয়ে পারিবারিকভাবে অনেক হেয়প্রতিপন্ন হয়েছেন তারা।

পরবর্তী বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে গত ১৭ ডিসেম্বর প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচ করে আবারও বরগুনা সরকারী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ফরম পূরন করেন তিনি। মায়ের কৌতূহল মেটাতে ওইদিনই কলেজ থেকে ২০১৯ সালের এইচএসসি’র নম্বর ফর্দ (ট্রান্সক্রিপ্ট) উত্তোলন করে তাহিরা দেখতে পান তিনি কোন বিষয়েই অকৃতকার্য হননি। তিনি পেয়েছেন জিপিএ-৩.৮৩ (এ-)।

গত ২২ ডিসেম্বর বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে তাহিরার ভাই ইমন তার বোনের ফল ফের পরখ করার অনুরোধ করেন। চেয়ারম্যান তার রোল নম্বর নিয়ে তার নিজের মুঠোফোনে সার্চ দিয়ে তাহিরা ফেল করেছেন বলে জানায়। এ সময় তাহিরার ভাই ইমন বোর্ডের ট্রান্সক্রিপ্টে পাশের প্রমাণ দেখালে চেয়ারম্যান বোর্ডের সিস্টেম এ্যানালিস্টকে ডেকে পাঠান। তিনি নিজেদের কিছু ভুলত্রুটির কথা জানান চেয়ারম্যানকে। এ সময় চেয়ারম্যান পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ভুল সংশোধন করে দেয়া হয়েছে বলে ইমনকে জানান। ওই সময়েও টেলিটকের ক্ষুদে বার্তায় তাহিরাকে ফেল দেখানোয় এই ভুলের দায় টেলিটকের উপর চাপানোর চেষ্টা করেন বোর্ড চেয়ারম্যান। শেষ পর্যন্ত বোর্ড কর্তৃপক্ষের কোন সদুত্তর না পেয়ে বোনের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি বছরের দায় কে নেবে- প্রশ্ন রেখে অফিস ত্যাগ করেন ইমন।

তাহিরার মা সেলিনা খানম জানান, তার মেয়ের সবগুলো পরীক্ষা ভালো হয়েছিলো। সে এ প্লাস পাওয়ার আশা করেছিলো। পরীক্ষার পর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংও করে। ইতিমধ্যে মেয়েকে বিয়েও দেন তারা। কিন্তু ফল দেখে তিনিসহ পুরো পরিবার খুবই হতাশ হন। এই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য যারা দায়ী তাদের কঠোর শাস্তি চান তাহিরার মা।

বরগুনা সরকারী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুস সালাম বলেন, ফল প্রকাশের সময় তাহিরাকে ফেল দেখেছি। এখন দেখছি পাশ। এটা বোর্ডের বিষয়। তবে বোর্ডের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. আনোয়ারুল আজিম বলেন, টেকনিক্যাল মিসটেক হতেই পারে। ফল ঘোষণার ১৫ দিন পর ফের ফল সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার্থী আবেদন করলে যাচাই-বাছাই করে সংশোধনী অনলাইনে দেয়া হবে বলে তিনি জানান। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিজেও নবম বিসিএস পরীক্ষায় মিসটেকের শিকার হয়েছিলেন বলে জানান।

বরিশাল বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস বলেন, এই শিক্ষার্থী অন্য জায়গা থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। এ জন্য কিছু তথ্য বিভ্রাট হয়েছে। টেলিটকের প্রকাশিত ফলে ভুল ছিলো। পরে সংশোধন করে রেজাল্ট দেয়া হয়। কিন্তু ওই শিক্ষার্থী কিংবা তার পরিবার কোনদিন কলেজে গিয়ে খোঁজ নেয়নি। এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষও ওই ছাত্রীর পরিবারকে বিষয়টি অবহিত করেনি। এখন সে যদি আগের ফলে (এ-) সন্তুষ্ট থাকে ভালো। না হলে সে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিতে পারে। ভুল হবে না এই গ্যারান্টি দেয়ার কোন সুযোগ নেই বলে জানান বরিশাল বোর্ড চেয়ারম্যান।