একটি সড়ক দূর্ঘটনা,যেন (একটা পরিবারের) সারা জীবনের কান্না !

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২০

 

সড়ক দূর্ঘটনা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও মর্মস্পর্শী ঘটনা।এ দূর্ঘটনায় প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ,প্রতিদিন ধূলিস্মাত হয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষের ইচ্ছা, স্বপ্নসাধ। খবরের পাতা খুললেই এটির সত্যতার প্রমান পাওয়া যায়। আসলেই কি খবরের কাগজে সব দূর্ঘটনার খবর সঠিকভাবে ফুটে উঠে? নাকি কত খবর চিরতরে বেখবর হয়ে যায় অনেক খবরের অন্তরালে? আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় সমস্যার নাম এই সড়ক দুর্ঘটনা। তাই এ সমস্যাকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই; বরং সড়ক দুর্ঘটনা রোধ জাতীয় দাবি হওয়া উচিত। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত যেভাবে মানুষের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে তাতে যেন জীবনের কোনো মূল্য নেই! পত্রিকার পাতা খুললেই দুর্ঘটনার বীভৎসতার খবর আমাদের চোখে ভেসে উঠে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঘর থেকে বাইরে গিয়ে সুস্থ অবস্থায় ঘরে ফেরা যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। জন্ম-মৃত্যু ও মানুষের নিয়তি নির্ধারিত। সময় ও জলস্রোতকে মানুষ যেমন কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারে না, তেমনি মৃত্যুও। প্রতিটি দূর্ঘটনার মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তবে এমন কিছু মৃত্যু আছে যা মানুষ সহজেই মেনে নিতে পারে না। রোগে-শোকে, বার্ধক্যে মানুষের মৃত্যু হলে স্বজনরা যতটুকু আহত হন তার চেয়ে অনেক বেশি মর্মাঘাত পান অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে কেউ মারা গেলে। এ কারণে প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যু কামনা করেন। অনেকেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়ে মিছিল, মিটিং, জনসভা, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপুর্ণ স্থানের অন্যতম। এখানে প্রতি কিলোমিটারে যতজন লোক বসবাস করে, তা বিশ্বে বিরল।

সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরে সীমাহীন অব্যবস্থারই নামান্তর। পত্রিকার পাতা, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গনমাধ্যম ও টিভির পর্দায় আমরা প্রতিনিয়ত দেখি শত সড়ক দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্র। যন্ত্রদানবের তাণ্ডবতায় প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে আবালবৃদ্ধ-বনিতাসহ শিশু, ছাত্র, যুবক, বৃদ্ধ ও নানা বয়স ও শ্রেণির লোকের। হৃদয় ও অন্তঃকরণ বিজলীর মতো কেঁপে ওঠে যখন দেখি একই পরিবারের পাঁচ-ছয়জন একই সঙ্গে নিহত হয় বা পরিবারের একমাত্র আয়সক্ষম ব্যক্তি সড়ক দূর্ঘটনার নির্মমতার শিকার হয়ে পুরো পরিবারকে জনমের মতো অন্যের উপর নির্ভরশীল করে বোঝা করে দিয়ে যায়, এরকম কত ঘটনা প্রতিদিন ঘটে তার কোন ইয়াত্তা নেই ! সাথে আছে মহা যানজট। এই যানজট প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে, সাথে অতিষ্ঠ করে তুলছে জনজীবন। সাথে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় সময় কাটানোর তীক্ত অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন কতসময়, কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, শারীরিক-মানসিক প্রতিকূলতায় মানুষের কত কষ্ট হয়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর সাধারন মানুষের কত নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়, ভুক্তভোগী মাত্রই ওয়াকেফহাল!

সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু যে প্রাণহানি ঘটছে তা নয়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, আহতদের অঙ্গহানি ও যানবাহনের ক্ষতি হলো সরাসরি প্রভাব। এছাড়া দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত একেকটি মানুষের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটি পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনও এ ক্ষতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিকার। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনায় মারা গেলে, সেই পরিবার পথে নামতে বাধ্য, তাই সে পরিবারের নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তবে মারা যাওয়া বা আহত, পঙ্গুত্ববরণ; যাই হোক না কেন এটি একটি পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। অথচ আমরা প্রতি মুহূর্তেই এই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। কিছুতেই যেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। এই গত ১৩-নভেম্বর-২০২০ তারিখের ভোর সকালে উখিয়ার প্রবীণতম মুরব্বী, সহজ-সরল মাটির মানুষখ্যাত বড় ভাই লোকমান হাকিম (৭০) মারা যান একটি মাল বোঝাই পিক আপে পীষ্ট হয়ে। এর কিছুদিন পুর্বে কুতুপালং বাজারে সাংবাদিক নুর মোহাম্মদ সিকদার তার কর্তব্য কাজে যাবার সময় অদক্ষ টমটম চালক তার মোটর সাইকেলকে ধাক্কা দিলে তাকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম মাস খানেক চিকিৎসা করিয়েও এখনও ঘরে বসে কালাতিপাত করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর পুর্বে উখিয়া ঘিলাতলী পাড়ার প্রবীণতম বিএনপি নেতা বিএ সিরাজ নিহত হয়েছিলেন গাড়ি দূর্ঘটনায়। তাছাড়া উখিয়ার ডিগলিয়া পালং এর বিএনপি নেতা সিরাজও নিহত হয়েছিলের গাড়ি দূর্ঘটনায়। তাছাড়া কত শতশত মায়ের বুক খালি হচ্ছে একএকটি গাড়ি দূর্ঘটনায় সে কথা বলাই বাহুল্য।

এর বড় প্রমাণ প্রতিদিন দুর্ঘটনায় প্রাণহানি। সুতরাং বিপুল ও বহুমুখী এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা যে যৌক্তিক, তা নানানভাবেই আলোচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত তিন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। ওভারস্পিড, ওভারটেকিং, যান্ত্রিক ও রাস্তার ত্রুটি। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে রয়েছে অন্যান্য কারণ। চালকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, গাড়ির অনুমোদন, সড়কের ত্রুটি, সঠিক তদারকির অভাবসহ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে গলদ।
চালকদের প্রতিযোগীতামূলক মনোভাব ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো সহ ১০ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত চার মাসে ১ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১ হাজার ৫৫২ জন নিহত ও তিন হাজার ৩৯ জন আহত হয়েছে। নিহতের তালিকায় ১৯৫ নারী ও ২৬৮ শিশু রয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়ক, আন্ত:জেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কসহ সারা দেশে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে।
বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) নিয়মিত মাসিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত কিছুদিনপুর্বে, এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২২টি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিক, ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারিতে ৩৮৩টি দুর্ঘটনায় ৫৩ নারী ও ৭১ শিশুসহ ৪১১ জনের প্রাণহানি এবং ৭২৫ জন আহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৪০১টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হয়েছে যথাক্রমে ৪১৫ জন ও ৮৮৪ জন আহত। নিহতের তালিকায় ৫৮ নারী ও ৬২ শিশু রয়েছে। মার্চে ৩৮৪টি দুর্ঘটনায় ৪৬ নারী ও ৮২ শিশুসহ ৩৮৬ জন নিহত ও ৮২০ জন আহত হয়েছে। এপ্রিলে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩২৭টি। এতে ৩৪০ জন নিহত ও ৬১০ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৩৮ নারী ও ৫৩ শিশু রয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমেছে। তবে এক মাসের তথ্যে দুর্ঘটনা-পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা যাবে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া জাতীয় কমিটির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যে ১০টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল সেগুলো অপরিবর্তিত রয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। কারণগুলো হলো:
১. চালকদের প্রতিযোগীতামূলক মনোভাব ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো
২. দৈনিক-চুক্তিতে চালক, কন্ডাক্টর বা হেল্পারের কাছে গাড়ি ভাড়া দেয়া
৩. অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ
৪. সড়কে চলাচলে পথচারীদের অসতর্কতা
৫. বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং
৬. দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো।
৭. ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব
৮. জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা
৯. সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি এবং
১০. স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, শুধু কঠোর আইন প্রণয়ন করে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সড়কখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা একান্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন দরকার, তেমনি আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। সে ক্ষেত্রে গণপরিবহনখাতে বিরাজমান নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সোচ্চার করে তোলা অপরিহার্য। এছাড়া যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমাতে নৌ ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত ও আধুনিকায়ন করতে হবে বলে আশীষ কুমার দে মন্তব্য করেন।
(চলবে……।)
এম আর আয়াজ রবি।

( লেখক কলামিষ্ট, মানবাধিকার কর্মী)