উখিয়ায় পল্লীবিদ্যুতের ভেল্কিবাজি-জনজীবন চরমভাবে অতীষ্ট- যেন দেখার কেউ নেই।

SIMANTO SIMANTO

BANGLA

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৬, ২০২২

 

এম আর আয়াজ রবি।

সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মানবতার শহর উখিয়ায় চলছে পল্লী বিদ্যুতের চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা। ঘন ঘন বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে অতীষ্ট হয়ে উঠেছে উখিয়ার জনজীবন। প্রতিদিনের লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ উপজেলার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। লোডশেডিংয়ের নামে প্রতিদিনই চলছে বিদ্যুৎ এর আসা-যাওয়ার খেল, যার কারনে জনজীবন আজ প্রায় ওষ্ঠাগত। গত মাস ও চলতি এপ্রিল মাসে বিদ্যুত সরবরাহ অবস্থার এত বেশি বিপর্যয় ঘটেছে যে লোক মুখে শুনা যায় ‘অত্র এলাকায় বিদ্যুৎ যায় না কিন্তু মাঝে মধ্যে আসে’।

সাধারণ মানুষের মনে খুবই আক্ষেপ, পল্লীবিদ্যুৎ নামক এই আপদ আর কতদিন মানুষকে এভাবে ভোগাবে?
পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি কক্সবাজার একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান । তারা সরকার থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করে পল্লী মানুষের সেবার মানবৃদ্ধি কল্পে নিয়োজিত একটি স্বায়িত্বশাসিত সংস্থা।এই সংস্থার কাজই হচ্ছে মানুষের কষ্ট লাঘব করে উন্নত মানের সেবা নিশ্চিত করণের ব্যবস্থা করা। অনেকটা সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্দ্যোগে গড়ে উঠা ব্যাংকগুলোর মতই!

কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি?
উখিয়া শতভাগ বিদ্যুতায়নের সাইন বোর্ড লাগানো এটা যেন কাগুজে দলিল। এটা চরম একটা মিথ্যাচার বা শঠতাও বটে। ঠিক যেন কাজীর গরুর অবস্থা! গরু, কিতাবে থাকলেও ঘোয়ালে দেখা মেলা ভার! বাস্তবে শতভাগ বিদ্যুতায়নের সংজ্ঞা কি, তার বাস্তবতা এখানে কতটুকু আছে তা ভুক্তভোগী মাত্রই ওয়াকেবহাল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শতভাগ বিদ্যুতায়নের নামে সুন্দর নাটক মঞ্চায়ন চলছে এখানে।

উখিয়ায় মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। সাথে জোরপুর্বক বাস্তুহারা মায়ানমার নাগরিক আছে আরও প্রায় ৮ লাখ। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্টীর বিদ্যুৎ চাহিদা পুরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে কিনা তা একটা বড় প্রশ্ন রয়েই যায়। ২৪ ঘণ্টায় কয় মিনিট বা কয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয় পল্লীবিদ্যুত কর্তৃপক্ষই তা ভাল জানবেন। চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি থাকার কারনে অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম চাহিদা অনুপাতে যোগান এর ব্যত্যয় যে এখানে ঘটছেনা তা বলাই বাহুল্য!

অত্র প্রতিবেদক পল্লীবিদ্যুৎ উখিয়া এর সম্মানিত ডিজিএম সাহেবের কাছ থেকে জেনেছেন, উখিয়ায় পল্লীবিদ্যুৎ কার্যক্রমে বর্তমানে ৭২ হাজার মত ভোক্তা রয়েছে। গত বছরের বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২০ মেগাওয়াট কিন্তু এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩১ মেগাওয়াট। কিন্তু বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ বরাদ্দ আছে কিনা, তাও একটা বিবেচনার বিষয়।

এ ব্যাপারে পল্লীবিদ্যুৎ উখিয়ার সম্মানীত ডিজিএম বলেন, ‘চাহিদার সাথে সরবরাহের ইতিবাচক সম্পর্ক অবশ্যই আছে কিন্তু আমাদের চাহিদা ৩১ মেগাওয়াট। আমরা চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ বরাদ্দের জন্য রিকুইজিশন করা এবং তা পেয়েও থাকি। কিন্তু বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি অবস্থা বিরাজমান থাকায় সারা দেশের ন্যায় উখিয়াতেও বিদ্যুতের লোডশেডিং ছিল তা আমি অস্বীকার করছিনা কিন্তু গত ১২-এপ্রিল থেকে বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে গ্যাস উৎপাদন স্বাভাবিক হবার কারনে বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে । তিনি আরও যোগ করেন, ‘ এখন বৈশাখ মাস যেকোন মুহুর্তে কাল বৈশাখীর হানা আসবে স্বাভাবিক। যেকোন স্থানে বাতাসে বা গাছ পড়ে বিদ্যুৎ লাইনের তার ছিঁড়ে গেলে সেই ছিঁড়া তারে হাত না দেবার এবং সাথে সাথে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসকে অবহিত করার অনুরোধ রইল ‘।

উখিয়ার মুহুরীপাড়ার জনৈক আজিজ বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদ্যুত কখন আসে কখন যায় এটার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। দিনে-রাতে কতবার যে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার খেলায় মেতে থাকে তা ভুক্তভোগীরাই বেশি অনুভব করেন। বিদ্যুৎ না থাকার ব্যাপারে আগে থেকে থাকে না কোনো নোটিশ, মাইকিং, প্রচারণা। প্রচারণা না থাকায় সাধারণ মানুষ পড়ে যায় বিভিন্ন রকমের বিপাকে। পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।’

ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, বর্তমানে উখিয়া পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গ্রাহক সেবাকে গুরুত্ব না দিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিশেষ গোষ্ঠীপ্রীতি ও ঘুষ বাণিজ্যকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। টাকা ছাড়া বিদ্যুতের কোনো কাজই হয় না। কক্সবাজার জোনাল অফিস উখিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির রয়েছে একাধিক দালালচক্র। দালালের মাধ্যমে অবৈধ লেন-দেন হয় বলে ভুক্তভোগী একাধিক গ্রাহক এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। উখিয়া ঘিলাতলি এলাকার শামসু বলেন, ‘বিদ্যুতের নিত্য আসা-যাওয়ার খেলায় আমরা খুবই অতীষ্ঠ, তিক্ত ও ক্ষুব্ধ। একদিকে গ্রীষ্মকাল অন্যদিকে পবিত্র রমাদান মাস-সাহরি, ইফতার ও তারাবি-মুসলমানদের রুটিন কাজ। কিন্তু কোন সময় বিদ্যুতের সঠিক সরবরাহ না পেলে কেমন লাগে আপনারা বলুন। একদিকে ভেঁপসা গরম অন্যদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ না থাকায় বিশেষ করে অসুস্থ ব্যক্তি ও শিশুদের নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে’।

মুহুরি পাড়া এলাকার আশি উর্ধ্ব ময়মুরব্বি রহমান সাহেব বলেন, ‘বিদ্যুতের সরবরাহ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি নিশ্চয়ই মুসলিম নয়। কারন সাহরি, ইফতার ও তারাবির সময় কারেন্ট পাওয়া না গেলে তু ঐ কারেন্টের দরকার বা কি’? ফলিয়া পাড়া এলাকার গ্রাহক সিরাজ বলেন, ‘’বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার সময় লো ভোল্টেজের কারণে আমার বাসার ফ্রিজ ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। ঘন ঘন ভোল্টেজ উঠা নামা করায় ইলেকট্রিক বাল্বের স্থায়িত্ব যেমন কম হচ্ছে, মিটারের রেটিং বেশি ঘুরে ভোক্তাদের পকেট কেটে সর্বশান্ত করছে’।

উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক মুসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘অফ পিক আওয়ার বলতে দুটো শব্দ আছে। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের ধারনা থাকা উচিত ছিল পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা যেমন বেশি, ঠিক তেমনি গ্রীষ্মকালে সেচ ব্যবস্থা থাকবে, কাল বৈশাখী ঝড় থাকবে, গরমে ফ্যান, ফ্রিজ, এসি চলবে। তাই পর্যাপ্ত বিদ্যুতের যেমন প্রয়োজন আবার বিদ্যুতের লাইন রক্ষণাবেক্ষণে অতিরিক্ত লোকেরও প্রয়োজন । আমার মনে হয় না পল্লী বিদ্যুত কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তাদের পুর্ব প্রস্তুতি আছে। তারা পিক আওয়ারের জন্য প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত খন্ডকালীন লোক নিয়োগ করে আপদকালিন চাহিদা পুরন করতে পারেন। এ ব্যাপারে তারা বরাবরই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে যা সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর লাইন মেরামতে পল্লী বিদ্যুৎ কী বরাদ্ধ দেয় না? বরাদ্দ দিলেও এগুলো যায় কোথায়? লাইনের ওপর থাকা গাছপালা কর্তন ও মেরামত না করায় বড় তুফানে গাছপালা পড়ে তার ছিঁড়ে অনেক সময় ঘটেছে দুর্ঘটনা। এখন প্রায় প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎহীন হয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় গ্রাহকদের। জনসাধারণকে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না করলে হয়তো জনগন ফুঁসে উঠবে তখন সামাল দিতে পারবে না’।
উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, ‘বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামত চলছে এখানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সাধারণ গ্রাহকের দুর্ভোগের বিষয়টি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ মোটেই আমলে নিচ্ছেন না। ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসায় উপজেলার অনেক সাধারণ মানুষ পড়েছে নানা ধরনের বিপাকে। সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরাজ করছে চরম অসন্তোষ ও উত্তেজনা। কোনদিন এ গণঅসন্তোষ, গন বিস্ফোরণে রুপ নেয় আল্লাহই ভাল জানেন’।
পালংখালী ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন ’প্রচন্ড গরম, সাহরি, ইফতার ও তারাবি নামাযের সময় যেভাবে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে সাধারন জনগন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল যুগে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় ডিজিটাল হতে না পারলে সরকারে যতই উন্নয়ন বলেন, অগ্রগতি বলেন বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বলেন সবকিছু ভেস্তে যাবে। সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ দিচ্ছে কিন্তু অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলে আজ জনগণের এই ভোগান্তি। ফলে সরকারেরও ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় সাধারণ মানুষের কষ্ট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই গরমে বিদ্যুতের লোডশেডিং বন্ধ না হলে সাধারণ জনগণ দিনদিন ফুঁসে উঠবে’।
( চলবে….)