১ জানুয়ারি ১৯৭৩-এ কী ঘটেছিল?
———————————————
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের এক বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র মিছিলে প্রথম পুলিশি গুলিবষর্ণ ও ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৩ সালের ১ লা জানুয়ারি। শহীদ হয়েছিলেন মতিউল ইসলাম এবং মীর্জা কাদেরুল ইসলাম। মিছিলটি ছিল ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়নের ঘোষিত ‘ভিয়েতনাম দিবসের’ সংহতি মিছিল।
ভিয়েতনাম। পঞ্চাশের দশক থেকেই এই নাম বাঙালির মনে আসন নেয়। ষাটের দশকে এসে তা এক আবেগপূর্ণ নামে পরিণত হয়। সারাবিশ্বে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাধে। এমনকি খোদ আমেরিকাতেও এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিক্ষক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবী-বিবেকবান প্রগতিশীল মানুষ রাজপথে আন্দোলনে নামে। ষাটের দশক ছিল বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের এক সোনালি সময়। তখন ঔপনিবেশিকতার জাল ছিন্ন করে এক এক করে স্বাধীন হচ্ছে দেশ। সাম্রাজ্যবাদ পরাস্ত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষেই মানুষ উর্ধ্বে তুলে ধরছে সাম্য-মৈত্রী আর স্বাধীনতার বাণী। এসবের পিছনে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অনন্য। বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনের ঢেউ এদেশেও এসে লাগে। ফলে সেসময় এদেশে চলমান জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণার অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়ে যায় বিপ্লবী ভিয়েতনামের নাম। এদেশেও তখন শ্লোগান ওঠে, “তোমার নাম, আমার নাম-ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম।”
সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই আরেকটি শ্লোগান এদেশের মুক্তিকামী বাঙালির কণ্ঠে উঠে আসে-“বিশ্বজুড়ে দু’টো নাম- বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম”। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এদেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ভিয়েতনাম একটি দৃষ্টান্তমূলক অনুপ্রেরণা হিসেবে সাহস যোগায়। ‘আঙ্কেল স্যাম’-এর বিশাল প্রতাপশালী মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ‘আঙ্কেল হো’র বাহিনী যেভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছিল তা এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যও ছিল অনুকরনীয় ও অনুসরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিক কমান্ডাররা ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে তা সংঘটিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্তু করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। এইসবের মধ্য দিয়েই বিপ্লবী ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের আত্মার আত্মীয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও, ভিয়েতনাম তখনো শত্র“মুক্ত হয় নি। সুতরাং স্বাধীনতার পরও ভিয়েতনামকে নিয়ে মানুষের সেই আবেগ অটল থাকে। স্বাধীন দেশে ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলন আরো জোরদার হয়। বিশ্বব্যাপী ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল বিবেকবান মানুষের সাথে বাংলাদেশেও সজোরে উচ্চকিত হতে থাকে, “ভিয়েতনামের বীর জনতা-আমরা আছি তোমাদের সাথে”
৭২ সালের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধকে তীব্রতর করে। মার্কিন সামরিক বাহিনী স্বাধীনতাউত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়, হাই ফং প্রভৃতি শহরে ই-৫২ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা শুরু করে। নাপাম বোমার আক্রমণে গ্রাম-শহর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। এমনকি গ্রামে-গ্রামে ফসলের ক্ষেত পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। যেন মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যায়। এই ভয়াবহতা, নৃশংসতা তখন সারা বিশ্বের বিবেক কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের ছাত্র সমাজ এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও এই বর্বর নৃশংসতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও নিন্দা জানানো হয়। ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে এদেশের মানুষের মধ্যে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কাছে দাবি উত্থাপন করা হয় এই নারকীয় হামলার প্রতিবাদ করার জন্য। কিন্তু সরকার তা করে নি। উল্টো স্বাধীনতার এক বছরের মাথায়ই দু’একটা ঘটনায় মনে হতে থাকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি সরকারের নীতি সামান্য নরম হচ্ছে। তদুপরি দেশে সংঘটিত নানা ঘটনায় সরকারের দুর্বলতা ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড মানুষের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ততদিনে জাসদ সৃষ্টি হয়ে গেছে। সরকার বিরোধী আওয়াজও রাজপথে সোচ্চার হচ্ছিল। এই অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন ঠিক করে সরকারি দল, সরকারের ক্রুটি-বিচ্যুতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চাপ বাড়াতে হবে। সেইসাথে দেশকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদকে টার্গেট করে গণআন্দোলন জোরদার করতে হবে। এইসব বিবেচনা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনামে জোরালো বোমাবর্ষণ শুরু করল তখন ভিয়েতনামের সাথে সংহতির আন্দোলনও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্র ইউনিয়ন।
ইউরোপ ও আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নানা জঙ্গি রূপ এদেশের ছাত্রসমাজকে আকৃষ্ট করতে থাকে। ’৭২-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেই বিচ্ছিন্নভাবে এদেশে স্থানীয় উদ্যোগে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন পরিচালিত একটি ইনস্টিটিটিউট চালু ছিল। সেখানে ছাত্রদের জঙ্গি সমাবেশ হয় এবং ভাংচুর-অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে সেখানকার ইউএসআই-এস-এর সামনে এ ধরনের জঙ্গি বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে বই মেলায় ইউএসআইএস একটি বইয়ের স্টল খুলেছিল।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গিয়ে সেই স্টল তছনছ করে দেয়। এইসব বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদকে একটি কেন্দ্রীয় সংঘটিত রূপ দেয়ার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু সিদ্ধান্ত নেয় যে, পয়লা জানুয়ারি ‘ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে। বটতলায় একটা বড় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখান থেকে মার্কিন দূতাবাসে (তৎকালীন আদমজী কোর্টে তা তখন অবস্থিত ছিল) গিয়ে স্মারকলিপি দেয়া হবে। সেদিনের এই কর্মসূচির মূল দাবি ছিল ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে হবে। এটা ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর যৌথ কর্মসূচি। সমস্ত কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মাহাবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন, কামরুল আহসান খান, হারুন-অর-রশিদ প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন মূল নেতৃবৃন্দের মধ্যে আমি নিজে, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, নূহ-আলম-লেনিন আমাদের মাস্টার্স ডিগ্রি পরীক্ষার জন্য ছুটিতে ছিলাম। অবশ্য ওইদিন পরীক্ষা না থাকায় সকলের অনুরোধে আমি নিজে কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলাম। আমার সভাপতিত্বেই সেদিন বটতলার সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বক্তৃতা শেষে মিছিল রওনা হয় মতিঝিলের আদমজী কোর্টস্থ আমেরিকান দূতাবাস অভিমুখে। দোয়েল চত্বর, শিক্ষা ভবন, হাইকোর্ট মোড়, কদম ফোয়ারা পার হয়ে মিছিল ডানদিকে মোড় নেয়। সেসময় দেখা গেল ইউএসআইএস- এর বিল্ডিংয়ের সামনে (বর্তমানে প্রেসক্লাবের ঠিক উল্টো দিকের ভবনটি) বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন হয়ে আছে। ওদের হাতে হাতে রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান। পুলিশ দেখে মিছিলের শ্লোগান আরো উচ্চকিত হল। মিছিল এগিয়ে যেতে থাকল সামনের দিকে। পুলিশ তাদের জায়গা থেকে নড়চড় করল না। মিছিলের অগ্রভাগ তখনো ইউএসআইএস-এর রাস্তার মুখ অতিক্রম করে নি। এমন সময়ই অতর্কিতে শুরু হয়ে গেল পুলিশের গুলি বর্ষণ। এর আগে মিছিল থেকে একটা ঢিলও পড়ে নি। উচ্চ-শ্লোগান দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল। কোথাও ১৪৪ ধারা জারি নেই, কোনো সতর্কবাণী নেই, কোনো লাঠিচার্জ নেই, কোনো টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ নেই। একেবারে শুরু থেকেই গুলিবর্ষণ। শত শত রাউন্ড গুলি। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। কেউ কেউ দৌড়ে প্রেসক্লাবের ভিতরে ঢুকে যায়। অন্যরা বর্তমান কদম ফোয়ারার চত্বরের দিকে, সচিবালয় সহ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। খই ফোটার মতো মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে সবাই বিস্মিত, আতঙ্কিত। কি হয়েছে জানার জন্য সবাই তখন উদগ্রীব। ইতোমধ্যে গুলিবর্ষণ শেষ হয়েছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা অবশিষ্ট নেতাকর্মীদের উপর রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে তাদেরকেও সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। আমার কাঁধেও রাইফেলের আঘাত লেগেছিল। তার দাগ এখনো আছে। কিন্তু পুলিশের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েই হাজার কণ্ঠে শ্লোগান উঠলো, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই। খুনিদের ক্ষমা নাই’।
পরিস্থিতি একটু স্থিত হলে দেখা গেল রাস্তায় লুটিয়ে আছে আট/দশ জন ছাত্র। পুলিশ ইউএসআইএস-এর গেইটে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা এগিয়ে গেলাম পড়ে থাকা ছাত্রদের দ্রুত উদ্ধার করতে। আহত দশ/বার জনকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘটনাস্থলেই দু’জন মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার দু’জনকেই মৃত ঘোষণা করলেন। এরা হলেন জহুরুল হক হলের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মীর্জা কাদেরুল ইসলাম।
আহতদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল পরাগ মাহবুব। বুলেটের আঘাতে তাঁর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আবুল কাসেমের হাতের তালু ও বাহু ভেদ করে চলে যায় বুলেট। এরকম আরো আহত হয়েছিলেন ফরিদ হোসেন, আমিরুল ইসলাম, সুলতান আহমেদসহ অনেকেই। পুলিশের বর্বর গুলিবর্ষণে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে শহীদদের লাশ কাঁধে নিয়ে শুরু হলো মিছিল। সেই মিছিলে সোচ্চার প্রতিবাদে যোগ দিল ঢাকার বীর জনতা। বেরিয়ে পড়ল সাংবাদিকরা। বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল প্রেসক্লাবও। আহত হয়েছিল বাংলার বাণীর ফটোসংবাদিক রফিকুর রহমান।
বুলন্দ আওয়াজ তুলে ঢাকার রাজপথ পরিক্রম করে মিছিল বায়তুল মোকাররমে এসে থামল। সেখানে উপস্থিত সমবেত মানুষের সামনে আমি ঘোষণা করলাম পরদিন ঢাকাসহ সারা দেশে পূর্ণ দিবস হরতাল এবং বেলা ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ জনসভার কর্মসূচি।রাজনৈতিক নেতারাও তোপখানা ছুটে আসেন খোঁজ নিতে। জাসদের নেতারা আমাকে বলেন, ‘এখন তবে আসুন, সরকার উৎখাতের দাবিতে একসাথে লড়াইয়ে নেমে পড়ি’। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও এলেন। খোঁজ-খবর নিলেন। বুদ্ধি পরামর্শ দিলেন। তারা বললেন, ‘তীব্র প্রতিবাদ করুন। সাম্রাজ্যবাদের ইস্যুকে ছাত্র হত্যার ইস্যুর সাথে যুক্ত রাখুন। সরকার উৎখাতের দাবি এখনই তুলবেন না।’
সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সংম্মেলনে অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে পাশে রেখে আমি গুলিবর্ষণ ও ছাত্র হত্যার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং বলি যে, এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে জনতার দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে। আমি একই সাথে কতগুলো সুনির্দিষ্ট দাবির কথা তুলে ধরি, যেগুলো পরদিন পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে ৭ দফা আকারে আবার উত্থাপন করা হয়েছিল। দাবিগুলো ছিল :
১। ছাত্র হত্যার সাথে মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যিনিই জড়িত, তাকে অপসারণ করতে হবে।
২। দোষী পুলিশ কর্মচারীদের অবিলম্বে অপসারণ ও শাস্তি দিতে হবে।
৩। সরকারি হ্যন্ড আউট প্রকাশ করে ভিয়েতনামে মার্কিন বোমাবর্ষণের নিন্দা জ্ঞাপন ও ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য অপসারণের দাবি করতে হবে। ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
৪। ঢাকার ইউএসআইএস সহ দেশের সব মার্কিন প্রচার ও তথ্য কেন্দ্র বন্ধ করতে হবে।
৫। ১ লা জানুয়ারি সম্পর্কে প্রচারিত মিথ্যা ও বানোয়াট সরকারি প্রেসনোট প্রত্যাহার করতে হবে।
৬। মিছিলের উপর পুলিশ বা রক্ষী বাহিনী লেলিয়ে দেয়া বন্ধ করতে হবে।
৭। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা বারবার আমাকে প্রশ্ন করেন যে, আপনারা সরকারের পদত্যাগ দাবি করছেন কিনা? আমি এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাই। এবং সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো মেনে নেয়ার উপর জোর দিয়ে কথা বলি।
গুলিবর্ষণের ঘটনার পর পরই আমাদের সাথে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করার প্রস্তাব তাদেরকে দিয়েছিলাম। ছাত্রলীগ নেতারাও তাতে একমত হয়েছিল। তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে উল্লিখিত দাবিগুলো একসাথে উত্থাপনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে তারা উপস্থিত হন নি। সন্ধার পর থেকে তাদের মনোভাব পাল্টে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে পুরানো আইয়ুবি কায়দায় একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সমস্ত ঘটনার দায় ছাত্র ইউনিয়নের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। নিহত ও আহতদের দেখার জন্য প্রথমদিকে ছাত্রলীগ নেতারা এলেও, সেদিন সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসে নি। ছাত্র হত্যার ঘটনার জন্য জনতার দরবারে ক্ষমা চাওয়ার বদলে সরকার ছাত্রদের উপরেই মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু সেদিন ঢাকার বাইরে ছিলেন। তিনি সামান্য দুঃখপ্রকাশ করেও কোনো বিবৃতি দেন নি। ঘটনার পর পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে প্রগতিশীলদের সাথে আওয়ামী লীগের দূরত্ব বৃদ্ধি এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আমেরিকাকে তুষ্ট করার নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের সেই মহলটি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে মাঠে নেমে পড়ে।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর আহ্বানে সারা দেশে ২ রা জানুয়ারি সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালকে সমর্থন করেছিল আওয়ামী লীগ বাদে সমস্ত দল ও সংগঠন। রাজপথ সেদিন পরিণত হয়ে জনপদে। রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে লক্ষ-লক্ষ মানুষ। ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার সেদিন চলে নি, প্লেনের প্রপেলার ঘুরে নি। অফিস-আদালত, যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল সমাবেশ শেষে শহীদ কাদেরের লাশ নিয়ে শোক মিছিল এসে পৌঁছায় পল্টন ময়দানে। বেলা ২ টায় সেখানে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। লাশ বহনকারী মিছিল মুজিববাদী গুণ্ডারা ঢিল ছুঁড়ে হামলা করেছিল। দু’জন শহীদের লাশ সারা রাত বরফ দিয়ে ডাকসু অফিসে রাখা হয়েছিল এবং শহীদ মতিউলের লাশ সকালেই তার পরিবারের মাধ্যমে ফরিদপুরের পাংশার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বেলা ৩টায় আমার সভাপতিত্বে পল্টনে শুরু হয় জনসভার কাজ। সেদিন ঢাকা শহরের জনস্রোত মিশে গিয়েছিল পল্টনে। এই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ৭-দফা পুনঃব্যক্ত করা হয়। আমি আবেগপূর্ণ এক বক্তৃতা দেই। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলি যে, ‘নিজের সন্তানকে হত্যা করলে পিতৃত্বের দাবি করা যায় না। ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কোনো জাতির পিতা আর আমাদের দেশে নেই। ডাকসু থেকে তাঁকে যে জাতির পিতা উপাধি ও আজীবন ডাকসু সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল, তা আমরা আজ প্রত্যাহার করে নিলাম। ’ জনসভা থেকে এসময় মাহাবুবজামান উত্তেজিত হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডাকসু সভার সিদ্ধান্ত, বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতা সবার সামনে টুকরো টুকরো করে ফেলে। শোক র্যালি, মশাল মিছিলসহ পরবর্তী ৬ দিনের সংগ্রামের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। সভা শেষে বের হয় ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক মিছিল। ইউএসআইএস ভবনের গেইটের উপরে ইতোমধ্যেই লিখিত হয়েছিল ‘মতিউল-কাদের পাঠাগার’-এর নতুন নামকরণ। ভবনের ছাদে উঠে আমি মার্কিন পতাকার দণ্ডে উত্তোলন করলাম ভিয়েতনামের পতাকা। সামনে রাস্তার ডিভাইডারে নির্মিত ‘ভিয়েতনাম সংহতি স্তম্ভ’ উদ্বোধন করলাম।
সারা দেশে হরতাল অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। হরতালে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক কর্মী গ্রেফতার হয়। সরকারি দল হুমকি-হামলা শুরু করে। ঢাকায় তারা ডাকসু কার্যালয় তছনছ করে। ন্যাপ অফিসেও তারা হামলা করে। ৩, ৪, ৫ জানুয়ারি শত আক্রমণের মুখেও চলতে থাকে প্রতিবাদ আন্দোলন। ৫ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম থেকে বের হয় ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিল। আওয়ামী গুণ্ডারা তার উপর আক্রমণ করে। সন্ধ্যার আগে আগে ছাত্র ইউনিয়ন অফিস ও ন্যাপ অফিসে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। জেলায়-জেলায় চলতে থাকে হামলাবাজী। ৪ জানুয়ারি মেডিকেলের মর্গ থেকে মিরজাহান আলী নামের একজনের বেওয়ারিশ লাশ উঠিয়ে এনে তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলে যে, ‘ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ১ জানুয়ারির পরে ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যা করেছে’। সেই কথিত ছাত্রলীগ কর্মীর লাশ নিয়ে তারা মিছিলও করে। আমরা পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দেই যে উল্লিখিত লাশটি পুলিশের গুলিতে নিহত একজন হাইজ্যাককারীর, যার মৃতদেহ মর্গে রাখা হয়েছিল ৭ দিন আগে ২৭ ডিসেম্বরে। ‘সেলিমের কল্লা চাই’ বলে তারা মিছিল করতে শুরু করে। কিন্তু আন্দোলনের ক্রম অগ্রগতি স্তব্ধ না হয়ে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
সংগ্রামের দৃঢ়তার মুখে সরকার পিছু হটতে শুরু করে। তার কথা ও আচরণ নরম হয়ে আসতে থাকে। সরকার একে একে ৭ দফা মানার ঘোষণা দিতে শুরু কর। সরকার নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করে-
এক) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া হল।
দুই) বর্তমান স্থান থেকে ইউএসআইএস সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হল।
তিন) ভিয়েতনাম সরকারকে ঢাকায় দূতাবাস খোলার অনুমতি দেয়া হল।
চার) দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি প্রদান করল।
পাঁচ) আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। গুরুত্বর আহত পরাগ মাহাবুবের একজন ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও পরিবারের একজন সদস্য সহ উচ্চতর চিকিৎসার জন্য সরকারি খরচে লন্ডনে পাঠানো হয়।
ছয়) পয়লা জানুয়ারি গুলি বর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি অবিলম্বে কাজ শুরু করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশই প্রথম অ-কমিউনিস্ট দেশ যে কী-না দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ও ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমাদের দাবি ও সংগ্রামের মুখে সরকার যে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করেছিল, সেগুলো ছিল খবুই তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। মতিউল-কাদেরের রক্তের বিনিময়েই এই সাফল্য ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। সরকারকেও বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয়েছিল। গুলি বর্ষণের দায়ভার ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দেয়া থেকে সরকারকে সরে আসতে হয়েছিল। তদন্ত কমিটি গঠন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরিয়ে দেয়া, আহতদের চিকিৎসাসহ নানা দায়ভার সরকারকে নিতে হয়েছিল।
এই রকম একটি প্রেক্ষাপটেই ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তারপর পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হয়ে আসে। ১লা জানুয়ারির আন্দোলন ও মতিউল-কাদেরের আত্মদানের বিনিময়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান আবারো শক্ত করা এবং জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা বিকশিত করা সম্ভব হয়েছিল। এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যারা এক বছরের মাথায়ই আওয়ামী লীগকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল আন্দোলনের দাবিগুলো আদায় হয়ে যাওয়ায় তারা কিছুটা হতাশ হয়েছিল। মনক্ষুণ্নও হয়েছিল। তাই তারা হতাশ হয়ে এই অপপ্রচার শুরু করে যে, ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টি প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়েছে এবং আত্মসমর্পন করেছে। তাদের কাছে ভিয়েতনামের সাথে সংহতি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়পণ লড়াই জোরদার করা ইত্যাদির কোনো মূল্য ছিল না। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল একটাই ‘মুজিবকে হটাও’।
অনেকে অপপ্রচার করেন, পয়লা জানুয়ারি মতিউল-কাদের যে তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন তা ছাত্র ইউনিয়নের আপষকামীতার জন্য ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আসল সত্য হলো এই যে, শহীদের রক্ত বৃথা যায় নি। তাদের রক্তের বিনিময়েই সেদিন ছাত্র ইউনিয়নের দাবিগুলো সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদ কোণঠাসা হয়েছিল। ভিয়েতনামের মুক্তি-সংগ্রামের সাথে আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদার হয়েছিল।
ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা সেদিন আত্মসমর্থন করে নি। আত্মসমর্থন করে নি বলেই হত্যাকাণ্ডের পর অনেকদিন পর্যন্ত ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ৭-দফা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। সারা দেশে ছাত্র ইউনিয়ন প্রবল আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছে। আক্রমণের মধ্যেও সংগ্রামের ধারাকে অব্যাহত রাখা হয়েছিল। লাগাতার আন্দোলনের মুখেই দাবিগুলো মানতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। দাবিগুলো মেনে নেয়ার পরেই কেবল ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেছিল।
আজও ছাত্র ইউনিয়ন বীর শহীদের রক্তের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রেখেছে। এখনো এদেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রধান অনুপ্রেরণা মতিউল-কাদের। এই দিনটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতি দিবস’ হিসাবে প্রতি বছর পালন করা হয়। শহীদদের স্মরণ করার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করা হয়। যে স্থানে মতিউল-কাদের শহীদ হয়েছিল, সেই স্থানে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলী পুন:নির্মাণ করা হয়েছে। বীর শহীদের চেতনাকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতি স্তম্ভ’।
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি; বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও ডাকসু’র সাবেক ভিপি।
( সীমান্তবাংলা/ ৩০ ডিসেম্বর ২০২০)