প্রতিনিধি ১ অক্টোবর ২০২০ , ১০:০৫:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ
এম আয়াজ রবীঃ রোহিঙ্গা যে একটা মারাত্মক সংকট ও সমাস্যা, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানবতাবাদি বাংলাদেশী জনগন। এ সংকট দিনকে দিন তীব্র থেকে যে তীব্রতর হচ্ছে, তাও আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যতই দিন যাচ্ছে, কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে বাড়ছে রোহিঙ্গা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় এমনিতেই বাঙালির চেয়ে পাঁচ গুনের বেশি রোহিঙ্গার বাস—এর মধ্যে এমন অযাচিত কর্তৃত্ব ও আধিপত্যবাদের আশংকা রীতিমত শঙ্কা জাগাচ্ছে জনমনে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্টি প্রায় পুরোপুরি অশিক্ষিত, নীচুমানের জীবন যাপনে অভ্যস্ত, অপরাধপ্রবণ। মায়ানমারের রোহিঙ্গারা ব্যতিত আরও অনেক মুসলমান আছে, তাদের সাথে সেনাবাহিনী কিংবা স্থানীয়দের সাথে আজ অবধি কোন ধরনের খারাপ কিছু ঘটেনি। ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের সাথে সব সময় বিপরীতমুখী অবস্থানে ছিল বলে একটা ট্রাডিশন আছে। তবে একসময়, তারা এত উচ্ছৃংখল ও অপরাধপ্রবণ ছিলনা। দিন যত যাচ্ছে ততই অবনতি হচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পরিবেশ, প্রতিবেশ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলও তুংগে বিরাট এই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত (আগস্ট, ২০২০) কমপক্ষে ৫০ জন রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই খুন হয়েছেন, তাদের গোষ্টি ও আধিপত্যবাদী স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারনে। এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ও নিহতের সংখ্যা প্রায় সমপরিমান। যার প্রত্যেকটি ঘটনার আড়ালেই রয়েছে এক একটি অপকর্মের নকশী কাঁথা ও বীনি সুতোর বাঁধন !
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক রোহিঙ্গা অন্য রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা করতে দু সেকেন্ড চিন্তা করেনা ও দ্বিধাও করে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ, উপগ্রুপ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রয়েছে। এক এক সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী গোষ্টির মধ্যে ক্যাম্পে প্রভাব, প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ক্যাম্পের ভিতরে বিভিন্ন প্রকার বেআইনি কাজসহ চলছে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। খালি হাতে এক কাপড়ে আসা রোহিঙ্গারা আর আগের মতো নিস্ব ও অসহায় অবস্থায় নেই। তারা বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। আগে রোহিঙ্গারা ইয়াবা বহন করতো, এখন রোহিঙ্গারাই ইয়াবা ব্যবসা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নির্যাতনে শিউরে ওঠার মতো তথ্য বেরিয়ে আসছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। রোহিঙ্গারা জানান, প্রতিটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের রয়েছে টর্চার সেল। তাদের মতের বা কথার বিরুদ্ধে চললে বা গেলে, সাধারণ রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে তুলে নিয়ে টর্চার সেলে নির্যাতন করা হয়। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যেই একাধিক রোহিঙ্গা নেতাকে গলা কেটে হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের ফলে ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখন কমে আসলেও সম্প্রতি মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অপহরণ ও আধিপত্য বিস্তার। গেল এক সপ্তাহ ধরে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন ও পুরনো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। তার মধ্যে অপহরণের শিকার হয়েছে অন্তত ১৫ জন রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে ৬ রোহিঙ্গা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসলেও অন্যদের এখনো খোঁজ নেই বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা এই প্রতিবেদককে জানান, ক্যাম্পে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপ মুন্না গ্রুপ গত কয়েকদিনে ১৫ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করেছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে ৬ জন।
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর-২০২০ তারিখ দুপুর ২.০০ ঘটিকার সময়, কৌশলে রোহিংগা সন্ত্রাসীরা সিএনজি ভাড়া নিয়ে ড্রাইভার সেলিম প্রকাশ হোসেন নামের একজন বাংলাদেশীকে কুতুপালং মেইন রোড বাজার হয়ে মোচরা পয়েন্টে নিয়ে যায়, তখন ওঁতপেতে থাকা এক দল রোহিঙ্গা এসে ড্রাইভার সেলিম প্রকাশ হোসেন কে আক্রমণ করে, মারধর করে গাড়িটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বিগত কয়েক দিন গাড়িটির কোন খুঁজ মেলেনি। এর পর গত ২৭/০৯/২০ বিকাল ৪ টার গাড়ির সন্ধান মিলে রোহিঙ্গা ক্যাডার মুন্নার ডেরায়। এরপর কৌশলে ঐ এলাকার বসবাসকারী জনৈক ব্যক্তিদের কাছ থেকে সিএনজি ও কারা এ ঘটনার সাথে জড়িত জানতে চাইলে তারা সরাসরি দুইজনের নাম বলেন এবং তাদের সাথে আরোও ২০-৩০ জনের একটা ছিনতাইকারী দল জড়িত আছে বলেও জানান।
অন্য সূত্রে জানা যায় গাড়িটি যারা অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করেন, তাদের মধ্যে ফয়সাল নামের একজন রোহিংগা পূর্বের সিএনজির ড্রাইভার ছিলেন বলেও জানা যায়। তার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন ফয়সালের বাবা রোহিংগা মোঃ ইউছুফ তারা কুতুপালং পুরাতন রেজিস্ট্রার এর বাসিন্দা। এরপর গাড়ি ফেরত পাবার জন্য তারাই মোবাইলে ফোন করে উক্ত গাড়ির মুক্তিপণ হিসেবে ৪ লক্ষ টাকা দাবি করেন। এই খবর সিএনজি মালিক সমিতির শ্রমিক নেতারা জানার পরে টাকা দিতে অপারগতার কথা জানান। চাঁদা বা মুক্তিপণ দিতে অপারগতার কথা জানার পরে রোহিঙ্গা ডাকাতরা গত ২৮শে সেপ্টেম্বর-২০২০ তারিখ, বিকালে উক্ত ছিনতাইকৃত গাড়ির মালিক মোঃ জাফর আলম, পিতাঃ নাজির হোসেন, (যিনি কুতুপালং ৯ ওয়ার্ডের স্থানীয় বাসিন্দা) এ-র বাড়িতে ডাকাত রোহিংগা মুন্না বাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ করে প্রায় ৫ লক্ষ টাকার জিনিস পত্র নষ্ট করেন বলে জানান স্থানীয় সিএনজি সমিতির সভাপতি।
এই খবর শ্রমিক নেতারা শুনলে তারা প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন শ্রমিক নেতা মাসুদ আমিন শাকিল, সাধারণ সম্পাদক সিএনজি মালিক সমিতি এবং সৈয়দ হোসেন সিএনজি মালিক সমিতির পরিচালক ও কুতুপালং এর সভাপতি। প্রতিবাদ সমাবেশের পরে সবাই যখন যার যার মত চলে যায়, ঠিক সেই মুহুর্তে সরাসরি রোহিঙ্গা মুন্না বাহিনীর সদস্যরা প্রায় ৫০-৬০ টি অস্ত্র নিয়ে কচুবনিয়ার সিএনজি অফিসে আক্রমণ করে সবাইকে অস্ত্র ঠেকিয়ে শাসায়ে যায়- সিএনজির ব্যাপারে কোন টু শব্দ করলে সবাইকে রোহিংগা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করবে বলে-হুমকিও দিয়ে চলে যায়। এই ব্যাপারে কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ মহোদয় এর কাছে শ্রমিক ও শ্রমিক নেতা কর্তৃক স্বারক লিপি দেওয়া হয় বলেও জানা যায়।
রোহিঙ্গারা মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করছে বলে স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করেছেন। এনজিও গুলো শুধু রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রান সামগ্রী বিতরণ করে থাকেন। কিন্তু আমার জানা মতে এনজিওদের ত্রানের ৩০% হোস্ট কমিউনিটির জন্য ব্যয় করার কথা থাকলেও, কোন এনজিও তা মেনে চলে না। সুতরাং, যে হোস্ট কমিউনিটি তারা তাদের ভিটে বাড়ি, জায়গা সম্পত্তি রোহিঙ্গা অতিথিদের জন্য ত্যাগ করেছেন, কত হাজার হাজার বনভুমি উজাড় করেছেন, প্রাকৃতিক পেরেকখ্যাত পাহাড়গুলো সাবাড় করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিলীন করেছেন, সেই হোস্ট কমিউনিটির জন্য তেমন কিছু এনজিও/আইএনজিও যেমন করেনি, তেমনি বাংলাদেশ সরকারও তেমন নজর দেয়নি বলে স্থানীয়রা অভিযোগের সুরে উপস্থাপন করছেন। এটা আসলে স্থানীয়দের এক ধরনের বৈষম্যের শিকার বলা চলে । কিন্তু স্থানীয়দের উঁচু মুল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে অতি কষ্টে কালাতিপাত করতে হচ্ছে।
অথচ রোহিঙ্গা জনগোষ্টি এখানে অবাধে চলাচল করার স্বাধীনতা পাচ্ছে, তারা তাদের নিজস্ব ক্যাম্পের আওতায় একচেটিয়া দোকান করা-ব্যবসা করা, শ্রমিক হিসেবে সাধারণ কাজ করা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন এনজিও ও আইএনজিও হয়ে বিভিন্ন পোষ্টে চাকুরী করা ছাড়াও ইয়াবা ও বিভিন্ন মাদকের ব্যাপক বিস্তৃতি হচ্ছে তাদের মধ্যে। ইয়াবা ও মাদকের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মায়ানমারে পাচার হয় বলে বিভিন্ন গবেষনায় উঠে এসেছে। অনেক রোহিঙ্গা নেতা কোটিপতি বনেছেন কেবল ইয়াবা ব্যবসা করে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসে। যার দালাল রোহিঙ্গারা। সাথে আছে কিছু দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহল, যারা জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী, শুভাকাংখী। ক্যাম্পেই তারা নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন অতি যত্নে। প্রায় শুনা যায়, ছোটখাটো একটা প্রশাসন তারাই চালায় ক্যাম্পের ভেতরে। শুধু মোবাইল ফোন নয়, ক্যাম্পগুলোয় থ্রি-জি নেটওয়ার্কের ইন্টারনেটও ব্যবহার হচ্ছে দেদারসে। অস্ত্র বেচাকেনা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অর্থের বিনিময়ে মানুষ হত্যাও করেন অনেকে। চুরি-ডাকাতি, অপহরণ- মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ হরহামেশাই ঘটছে তাদের মাধ্যমে। যৌন ব্যবসা, সমুদ্র পথে নারী ও শিশু পাচার তথা মানবপাচারের সঙ্গেও জড়িত রোহিঙ্গা নেতাদের নাম (মানবপাচারে সহায়তাকারী কিছু বাংলাদেশীও জড়িত বলে খবর পাওয়া যায়)। বাংলাদেশি পার্সপোর্ট নিয়ে বিদেশ যাত্রা, রোহিঙ্গা থেকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও অনেক। আমাদের দুর্নীতিকে কাজে লাগিয়ে বহু রোহিঙ্গার রয়েছে ন্যাশনাল আইডি কার্ড, স্মার্ট কার্ড ও পার্সপোর্ট।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হয়েছেন স্থানীয় অধিবাসী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত। স্থানীয় জনগণ ভুগছেন রোহিঙ্গা আতঙ্কে। ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। যা কক্সবাজারের পর্যটন খাতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে কোনো সন্দেহ নেই। কথা হলো, এমনিতেই রোহিঙ্গারা অপরাধপ্রবণ। কিন্তু দেশী বিদেশী বিভিন্ন মদদদাতাও রয়েছে কিনা, তা শনাক্ত করে দেখতে হবে। সম্প্রতি একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের। গোয়েন্দা সংস্থাটির হয়ে জেএমবি বা জামাত-উল-মুজাহিদিন রোহিঙ্গাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণে মদদ দিচ্ছে। পাক-মদদপুষ্ট জেএমবি’র কারণেই বাংলাদেশেও আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি বা আরসার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বাড়ছে ঝুঁকি।
এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে অন্য কোন কোন গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর সেটিও খতিয়ে দেখার বিষয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশের গণমাধ্যমের খবরের সূত্র ধরে কাজ করলে হবে না। সেন্ট মার্টিনসহ বঙ্গোপসাগর ও এতদ অঞ্চল নিয়ে মাথা ব্যথা আছে এমন দেশগুলোর গোয়েন্দারা এখানে কি কি কাজ করছে, তাও গুরুত্বের সাথে মনিটরিং করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এখানে অভ্যন্তরণী কূটনীতি কতটুকু কাজে লাগানো যায় সেটিই বড় বিষয়। মিয়ানমারকে আমরা বন্ধু মনে করলেও, তাদের আচরণ বন্ধু নয় প্রতিবেশিসুলভও নয়। চীন এবং ভারতকেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনও আমরা পরম বন্ধু হিসেবে পাইনি। প্রত্যেকটি দেশ তাদের জিওপলিটিক্সের আওতায় নিজের নিজের স্বার্থ চিন্তা করে চলছে। কিন্তু আমরা দিনে দিনে ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা বুনে যাচ্ছি কিনা সেটাও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু এখন কোনভাবেই বাইলেটেরেল বা দ্বি-পক্ষীয় নয়, এটি এখন মাল্টিলেটারেল বা বহুপক্ষীয় ইস্যুতে পরিনত হয়েছে। এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, জাপান, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের রাষ্ট্রসমুহ সাথে, অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর তাবৎ স্বাধীন দেশ সমুহের অর্থনৈতিক স্বার্থ এতদ অঞ্চলে জড়িত রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
সুতরাং, অতি সহজে রোহিঙ্গা সমাস্যার সমাধান হতে চলেছে এমন ভাবার কোন কারন নেই। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আসলেই কবে হবে জানে না কেউ। উপরন্তু, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট নানা সংকট ও সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। মাদক ও মানবপাচার, ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। তাদেরকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা ও নজরদারিতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। পুলিশের নিয়মিত ইউনিটগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে নিরাপত্তায় কাজ করছেন। শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় নিরাপত্তা ও নজরদারি জোরদার করতে আর্মড পুলিশের (এপিবিএন) একটি ব্যাটালিয়ন সৃষ্টি করে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কক্সবাজার এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ভাষানচরে পাঠানোরও চেষ্টা চলছে।
স্বরাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা মিয়ানমার নাগরিকের (রোহিঙ্গা) বর্তমান সংখ্যা হচ্ছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। এই হিসাব গত ২৮ মে (২০২০) পর্যন্ত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে সাত লাখ ৪১ হাজার ৮৪১ জন রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও আশ্রয়প্রার্থী এতিম শিশু রয়েছে ৩৯ হাজার ৮৪১ জন। আশ্রয় প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিবছর জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু। প্রতিবছর অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে ৩৫ হাজারের বেশি নারী। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি ব্যবহার হচ্ছে। শুধুমাত্র নতুন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্যাম্পের জন্য সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি বরাদ্দ করা হয়েছে।
দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী সেলের কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালির নতুন এলাকাকে ২২টি ক্যাম্পে বিভক্ত করা হয়েছে। এছাড়া উখিয়ার হাকিমপাড়া, জামতলী ও পুটিবুনিয়া এবং টেকনাফের কেরনতলী, উনছিপ্রাং, আলীখালী, লেদা, জাদিমুরা, নয়াপাড়া শালবন ও শামলাপুরকেও পৃথক পৃথক ক্যাম্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে সব মিলিয়ে ক্যাম্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪টি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, রোহিঙ্গাদের আইনি সহায়তাসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকাগুলোতে একাধিক পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নিয়মিত পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও আর্মড পুলিশের একটি নতুন ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছে সেখানে। মাদক ও মানবপাচার, জঙ্গি-সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য ‘ইমারজেন্সি মাল্টি সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স’ নামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের আওতায় আর্মড পুলিশের ১৪তম ব্যাটালিয়নকে সেখানে মোতায়েন করা হয়। এই ব্যাটালিয়নে সাড়ে তিন হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। এছাড়াও আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা যেনো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য ওই এলাকায় তারকাঁটার বেড়া দেওয়ার কাজ চলছে। স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যেকোনও ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ ও আইনি সহায়তার জন্য ‘কুইক রেসপন্স টিমে’র কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সভা ও সেমিনারের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর কাজও চলছে। ২০২১ সালের মধ্যে ৩৩৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ইমারজেন্সি মাল্টি সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স’ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৪ কোটি টাকা বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়ার কথা। বাকি টাকা ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার।
তবে গত ৩১-শে আগষ্ট-২০২০ তারিখে টেকনাফের ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের কেমেষ্ট্রীতে মেজর (অবঃ) সিনহা আরশাদ খান নিহত হবার পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আওতায় উল্লেখিত ফোর্সগুলোর তৎপরতা অনেকাংশে কমে গেছে বলে অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেছেন।স্থানীয় সর্বসাধারনের দাবি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশে পাশে বিভিন্ন বাহিনীর অবস্থান, ততপরতা, দৃশ্যমান ও এক্টিভ না রাখলে রোহিঙ্গাদের মত হিংস্র, বর্বর ও সন্ত্রাসী জাতিকে নিয়ন্ত্রন করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে রীতিমত অসাধ্য নয়, দুরুহ হয়ে পড়বে। সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পতিত হবে। ধন্যবাদ সবাইকে।
এম আর আয়াজ রবি।
(লেখক, কলামিষ্ট ও মানবাধিকারকর্মী)